অতিউগ্রতা বা অতিনম্রতা নয়, মধ্যপন্থা শিখুন :
আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মুবারক অভ্যাস ছিল যথাস্থানে যথাপোযুক্ত আচরণ করা। তাই সর্বক্ষেত্রে এক নীতি কার্যকর করা উচিত নয়; বরং স্থান-কাল-পাত্র হিসেবে নীতি ও পদ্ধতিতে অনেক পরিবর্তন আসতে পারে। আর এটাই প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার কাজ। কেউ যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জিহাদি চেতনা, উদ্দীপ্ত ভাষণ আর কঠোরতা-সংশ্লিষ্ট হাদিসগুলো একত্রিত করে দাবি করে যে, তিনি যদি এমন করতে পারেন তাহলে আমাদের করতে আপত্তি কোথায়; আমি বলব এটা অসম্পূর্ণ অধ্যায়ের কুফল। অনুরূপ কেউ যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাম্য, উদারতা ও ক্ষমার হাদিসগুলো এনে বলে, তিনি যদি দয়াবান ও ক্ষমাশীল হয়ে থাকেন তাহলে আমি করলে দোষ কোথায়; আমি বলব এটাও অসম্পূর্ণ অধ্যয়নের ভুল নতিজা। প্রকৃত অর্থে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদর্শে আদর্শবান হতে চাইলে তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনী দেখতে হবে। আংশিক নিয়ে আর আংশিক বর্জন করে চললে তা ভারসাম্যপূর্ণ হবে না; বরং এতে উম্মাহর উপকারের বদলে অনেক সময় ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে।
রাসুলুল্লাহ সা. সামগ্রিক জীবনে মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছেন। প্রয়োজনের জায়গায় কঠোরতা, আবার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে নম্রতা দেখিয়েছেন। দ্বীনি ব্যাপারে দৃঢ়তা, আর দুনিয়ার ব্যাপারে শিথিলতা দেখিয়েছেন। সর্বক্ষেত্রে এক অবস্থার ওপর সর্বদা অটল থেকেছেন বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। এ গুণটির সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মুসলিম দায়িদের। একজন দায়িকে অবশ্য অবশ্যই মধ্যপন্থা অবলম্বন করে চলতে হবে। অনেক সময় আমরা তাহকিকের জোরে বা সমর্থকদের সাপোর্টে কিংবা ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে দ্রুতই সমালোচনার জবান দারাজ করে ফেলি। এটা অনেক বড় একটি ভুল; কেউ স্বীকার করুক আর না-ই করুক। এতে দাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য চরমভাবে ব্যাহত হয়। আর সাধারণত এসব ক্ষেত্রে সত্যতা যাচাইয়ের সুযোগ বা আগ্রহ কোনোটিই থাকে না। সর্বশেষ এতে দলান্ধতা ও বিরোধিতা বাড়ে বৈ কমে না। সত্যকে প্রকাশ করতে হলে অবশ্যই অবস্থার প্রেক্ষাপট বুঝে কথা বলা উচিত। সকল ক্ষেত্রে, সবার জন্য একই নীতি প্রযোজ্য নয়। কোথাও তাহকিকি ভুল, তথ্যগত ভুল বা বুঝগত ভুল থাকলে তা প্রমাণ ও দরদের সাথে পেশ করা উচিত। উগ্রতার সাথে করলে মানুষ তা বর্জন করবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এটা হতে পারে যে, আমার তাহকিক বা রিসার্চটি অধিকাংশ মানুষের জানার বিপরীত। আর মানুষের জানার বিপরীতে বাস্তবতার নিরিখে এ রিসার্চটি সঠিকও হতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভুল হলো, এটাকে আমরা অনেক সময় চূড়ান্ত অহির মতো মনে করে বিপরীত মতের আলিমদের তুলোধুনো শুরু করি। এক্ষেত্রে আলিমদের অন্তরের অবস্থার ওপর আঘাত করে কাউকে বানিয়ে দিই তাগুতের গোলাম, কাউকে বানাই মুরজিয়া আর কাউকে বানাই সরকারের পদলেহী। অথচ এক্ষেত্রে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তারা সাধ্যমতো তাহকিক করেই ভিন্নমত পোষণ করেন। যদিও তাদের তাহকিক আপনার কাছে ভুল মনে হচ্ছে, আর তাদের কাছে আপনার তাহকিক ভুল মনে হচ্ছে। আর এটা হতেই পারে, এটা খুবই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে করণীয় হলো, এটাকে মতানৈক্যপূর্ণ বিষয় ধরে সহনশীলতার আচরণ করা। বেশির চেয়ে বেশি নিজের তাহকিকটি জনসম্মুখে প্রকাশ করে সবাইকে পড়ার সুযোগ করে দেওয়া। কিন্তু এক্ষেত্রে বিপরীত ঘরানার আলিমদের আক্রমণ করে তাদেরকে বিভিন্ন উপাধীতে ক্ষতবিক্ষত করা কিছুতেই সমীচীন নয়।
কোনো ভূখণ্ডে কাজ করতে হলে সেখানকার হক্কাপন্থী আলিমদের যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান দিয়ে কথা বলতে হবে। উম্মাহর দরদি ও আস্থাশীল আলিমদের ব্যাপারে মানুষদের মনে অকারণে নেগেটিভ চিন্তা বা অনাস্থা সৃষ্টি করা যাবে না। আলোচনা করতে হবে মৌলিক সব বিষয় নিয়ে। দ্বীনের উসুল বা মূলনীতি নিয়েই বেশি কথা বলতে হবে। সন্দেহ নেই যে, একজন ভালোমানের মুহাক্কিক আলিমেরও ভুল হতে পারে, তবে অবশ্যই সেটা সুন্দরভাবে আদব রক্ষা করে বুঝিয়ে বলতে হবে। কোথাও কারও পদস্খলন ঘটলে সেটা সংশোধনের নিয়তে সঠিক পন্থায় কাজ করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ ও সেন্সেটিভ বিষয়ে কখনো তাড়াহুড়ো কাম্য নয়। সর্বদা হক্কানি আলিমদের প্রতি শ্রদ্ধা ও আদবের দিকটি খেয়াল রাখতে হবে। হ্যাঁ, কারও ব্যাপারে যদি প্রমাণ হয়ে যায় যে, সে ইচ্ছাকৃতভাবে তাহরিফ করছে, কিংবা প্রকৃত সত্য বুঝার পরও দলপ্রীতির কারণে হকের বিরোধিতা করছে, সেক্ষেত্রে সীমার মধ্যে থেকে তার প্রতিবাদ ও যৌক্তিক সমালোচনা করাটাও একজন দায়ি আলিমের কর্তব্য। এছাড়া শুধু সন্দেহের বশীভূত হয়ে কারও ব্যাপারে বিরূপ ধারণা বা মন্তব্য করা থেকে আমাদের অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
সর্বশেষ কথা হলো, সময়টি এখন বড় নাজুক। এ সঙ্গিন মুহূর্তে আমাদের সবাইকে বিবাদ এড়িয়ে চলতে হবে। মতানৈক্যপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে বিদ্বেষ ও শত্রুতায় জড়িয়ে পড়া যাবে না। আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ের শীর্ষ আলিমদের সাথে নিয়ে, তাদেরকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে চলতে পারলে কাজের গতি অনেক বেশি হবে। অন্যথায় পারস্পরিক রেষারেষি, শত্রুতা ও হানাহানি বাড়তেই থাকবে। তাই একান্ত প্রয়োজন না হলে এখন সমালোচনা এড়িয়ে চলতে হবে। বর্তমান সময়ের হাল-হাকিকত ও শেষ জমানায় উম্মাহর করণীয় বিষয়ে বেশি করে কথা বলতে হবে। মুসলিমদের সচেতনতা বাড়াতে পজেটিভ আলোচনার কোনো বিকল্প নেই। অপ্রয়োজনীয় বিরোধিতায় জড়িয়ে পড়লে উভয় পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শয়তানও দ্বীনের নামে বিভিন্ন বাহানা তৈরি করে মতবিরোধের জালে আটকে রাখবে। তাই আমাদের খুবই সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধ থাকতে হবে। যথাসম্ভব সমালোচনা এড়িয়ে গঠনমূলক ও উম্মাহর প্রয়োজনীয় দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করতে হবে। সর্বোপরি কুরআনের ভাষায় আমাদের ‘উম্মাতান অসাতান’ হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
আল্লাহ আমাদের হক্কানি আলিমদের সর্বদা সত্যের ওপর অটল রাখুন এবং শাখাগত বিষয়ে শত ইখতিলাফ থাকা সত্ত্বেও সম্মিলিতভাবে এ অঞ্চলে দ্বীনি কাজসমূহ আঞ্জাম দেওয়ার তাওফিক দান করুন।
🖋️ মুফতি তারেকুজ্জামান তারেক দা.বা.