ইদে মিলাদুন্নবির এক্সরে রিপোর্ট :

পরিচয় ও সংজ্ঞা :
‘ইদ’ (عيد) শব্দটি মূলত (عود) থেকে নির্গত। এর শাব্দিক অর্থ ফিরে আসা। ইদ বলা হয় এমন উৎসব দিবসকে, যেদিনে মানুষের সম্মেলন হয় কিংবা ফজিলতপূর্ণ বা অতীতের গুরুত্ববহ কোনো ঘটনার স্মরণ করা হয়। বলা হয়ে থাকে, যেহেতু ইদ প্রতি বছর মানুষের মাঝে নতুন আনন্দ নিয়ে ফিরে আসে, এজন্য এ দিবসকে ‘ইদ’ নামকরণ করা হয়েছে। (আল-মুনজিদ : পৃ. নং ৫৩৬, প্রকাশনী : আল-মাতবাআতুল কাসুলিকিয়্যা, বৈরুত)

মিলাদ (ميلاد) এটি আরবি ولادة শব্দ থেকে নির্গত। এর অর্থ সন্তান প্রসব করা। শব্দটি আরবি ভাষার ظرف اسم এর সিগা। শাস্ত্র অনুযায়ী ظرف اسم এর ميم যদিও জবরযুক্ত হওয়া নিয়ম, কিন্তু খেলাফে কিয়াস কখনো জেরযুক্তও ব্যবহৃত হয়। যেমন منبر (মিম্বর), مينار (মিনার) ইত্যাদি। সুতরাং ইসমে জরফ হিসেবে এর অর্থ হবে, জন্মকাল। (লিসানুল আরব : পৃ. নং ৪৯১৫, প্রকাশনী : দারুল মাআরিফ, বৈরুত; আল-মুজামুল অসিত : ২/১০৫৬)

‘ইদে মিলাদুন্নবি’ বলতে আমাদের নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মবৃত্তান্ত আলোচনা করাকে বুঝানো হয়ে থাকে। অর্থাৎ, জন্মের আগমন মুহুর্ত থেকে নবুওয়াতপ্রাপ্তি পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনার আলোচনাকেই মিলাদ বলে।

মজার ব্যাপার হলো, শাব্দিকভাবে ‘ইদে মিলাদ’ অর্থ পবিত্র জন্মদিন হলেও অভিধানে এর ব্যববহারিক অর্থ করা হয়েছে, ক্রিসমাস হলিডে বা ইসা.-এর পবিত্র জন্মদিবস। (আল-মুনজিদ : পৃ. নং ৯১৮, প্রকাশনী : আল-মাতবাআতুল কাসুলিকিয়্যা, বৈরুত)

এতে বুঝা যায়, শব্দটি মূলত খ্রিষ্টানরা ব্যবহার করত, যা এখন নামধারী মুসলিমরা নিজেদের নবির শানে ব্যবহার করে থাকে। তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মদিন বুঝাতে ‘ইদে মিলাদ’ শব্দটির ব্যবহারই সঠিক নয়। হ্যাঁ, কেউ যদি খ্রিষ্টানদের কালচার ও সংস্কৃতি গ্রহণ করতে চায়, তার কথা ভিন্ন।

মিলাদের সূচনা ও ইতিহাস :
এর প্রথমসূচনাকারী নিয়ে মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। কারও মতে এ মিলাদুন্নবির সূচনাকারী হলো ফাতিমি খিলাফতের বাতিলপন্থী বাতিনি সম্প্রদায়।

শাইখ ফাহাদ আব্দুল্লাহ রহ. বলেন :

ويذكرون أن الدولة الباطنية أحدثت المولد النبوي ضمن موالد واحتفالات وأعياد أخرى كثرت مع الزمن
‘ইতিহাসবিদরা উল্লেখ করেন যে, বাতিনি সম্প্রদায় সময়ের সাথে ক্রমবর্ধমান নানা অনুষ্ঠান, উৎসব ও মিলাদের পাশাপাশি এই মিলাদুন্নবিরও প্রবর্তন করে।’ (আল-মাওলিদুন নববি বাইনাল মাশরুইয়্যাতি ওয়াল বিদআহ : ১/২, প্রকাশনী : আল-মাকতাবাতুশ শামিলা)

কারও মতে আর্বিল শহরের শাসক মুজাফফর কুকুবুরি ছিল এর প্রথম সূচনাকারী। আল্লামা সুয়ুতি রহ. বলেন :
وَأَوَّلُ مَنْ أَحْدَثَ فِعْلَ ذَلِكَ صَاحِبُ إِرْبِلَ الْمَلِكُ الْمُظَفَّرُ أَبُو سَعِيدٍ كُوكْبُرِي بْنُ زَيْنِ الدِّينِ عَلِيِّ بْنِ بَكْتَكِينَ،
‘মিলাদুন্নবি প্রথম প্রবর্তন করেন আর্বিল শহরের বাদশা মুজাফফর আবু সাইদ কুকুবুরি বিন জাইনুদ্দিন আলি বিন বাকতাকিন।’ (আল-হাবি লিল-ফাতাওয়া : ১/২২২, প্রকাশনী : দারুল ফিকর, বৈরুত)

তবে আল্লামা আবু শামা রহ.-এর বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, উমর বিন মুহাম্মাদ মোল্লা নামক এক বুজুর্গ মুসেল শহরে প্রথম এ মিলাদুন্নবির প্রবর্তন করে, আর বাদশা মুজাফফর তার অনুকরণ করে। তিনি বলেন :
وَكَانَ أول من فعل ذَلِك يالموصل الشَّيْخ عمر بن مُحَمَّد الملا أحد الصَّالِحين الْمَشْهُورين وَبِه اقْتدى فِي ذَلِك صَاحب أربل وَغَيره
‘মুসেল শহরে প্রথম এ কাজটি করে প্রসিদ্ধ বুজুর্গ শাইখ উমর বিন মুহাম্মাদ মোল্লা। আর্বিলের শাসক ও অন্যরা পরে তাকেই অনুসরণ করে।’ (আল-বায়িসু আলা ইনকারিল বিদায়ি ওয়াল হাওয়াদিস : পৃ. নং ২৪, প্রকাশনী : দারুল হুদা, কায়রো)

সুতরাং মিলাদুন্নবির প্রবর্তক মূলত ফাতিমি বংশের বাতিনি সম্প্রদায়। আর মুসেল শহরে এটার প্রথম পালনকারী ছিল উমর বিন মুহাম্মাদ মোল্লা। আর আর্বিলের শাসক কুকুবুরি হলো উমর বিন মুহাম্মাদের অনুসরণকারী।

মিলাদের প্রকারভেদ :
মৌলিকভাবে মিলাদের দুটি রূপরেখা আছে। এক : স্বর্বজনস্বীকৃত মিলাদ, দুই : মতবিরোধপূর্ণ মিলাদ।

প্রথম প্রকারটি হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মের সময়কাল থেকে নিয়ে নবুওয়াত পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনাবলী আলোচনা করা। এ প্রকারের মিলাদকে কেউ অস্বীকার করেননি; বরং আমাদের আকাবির উলামায়ে কিরামও তা স্বীকার করেছেন।

আল্লামা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি রহ. বলেন :
مجلس مولود مجلس خیر وبرکت ہے در صورتیکہ قیودات مذکورہ سے خالی ہو فقط بلا قید وقت معین و بلا قیام وبغیر روایت موضوع مجلس خیر وبرکت ہے صورت موجودہ جو مروج ہے بالکل خلاف شرع ہے اور بدعت ضلالہ ہے۔
‘মিলাদ তথা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে আলোচনার মাহফিল কল্যাণ ও বরকতের মজলিস হবে, যখন উল্লিখিত বাধ্যবাধকতা থেকে মজলিস মুক্ত থাকবে। সময় নির্দিষ্ট না করে, কিয়াম না করে এবং জাল হাদিস বর্ণনা না করলে সেটা তো কল্যাণ ও বরকতের মজলিস। কিন্তু বর্তমানের প্রচলিত পদ্ধতি পুরোপুরিই শরিয়ত পরিপন্থী এবং গোমরাহিমূলক বিদআত।’ (ফাতাওয়ায়ে রশিদিয়া : পৃ. নং ২৫৪)

তিনি আরও বলেন :
نفس ذکر ولادت منذوب ہے اس میں کراہت قیود کے سبب سے آتی۔
‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে আলোচনা করা উত্তম কাজ। এটা মাকরুহ হয় এতে নানারকম (বিতআতি ও মনগড়া) বিষয় থাকার কারণে।’ (ফাতাওয়ায়ে রশিদিয়া : পৃ. নং ২৫৮)

তবে এটি অনুমোদিত হওয়ার জন্য শর্ত হলো তাতে কোনো ধরনের রুসুম-রেওয়াজ না থাকার পাশাপাশি আবশ্যকও মনে করা যাবে না এবং এতে অংশগ্রহণ না করলে কাউকে ভর্ৎসনা করা যাবে না। কেননা, মুসতাহাব ও বৈধ কাজে বাধ্যবাধকতা থাকলে তা বিদআতে রূপান্তরিত হয়ে যায়।

আল্লামা তিবি রহ. বলেন :
مَنْ أَصَرَّ عَلَى أَمْرٍ مَنْدُوبٍ، وَجَعَلَهُ عَزْمًا، وَلَمْ يَعْمَلْ بِالرُّخْصَةِ فَقَدْ أَصَابَ مِنْهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْإِضْلَالِ
‘যে ব্যক্তি কোনো মুসতাহাব বিষয়ের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে এবং সেটাকে আবশ্যক করে নেবে, তাহলে শয়তান তাকে গোমরাহিতে নিপতিত করল।’ (মিরকাতুল মাফাতিহ : ২/৭৫৫, প্রকাশনী : দারুল ফিকর, বৈরুত)

দ্বিতীয় প্রকারটি হলো, বিভিন্ন রুসুম, বিদআত ও কিয়ামের মাধ্যমে মিলাদ অনুষ্ঠান করা; যা আমাদের এ উপমহাদেশে বিদআতিদের মধ্যে প্রচলিত আছে।

মূলত মিলাদের বৈধতা ও অবৈধতার মূল সীমারেখাই হলো এর সাথে যুক্ত বিভিন্ন রুসুম রেওয়াজ। সে সকল রুসুম-রেওয়াজের মধ্য হতে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো :

ক. অনির্ভরযোগ্য ও মওজু হাদিস বর্ণনার আধিক্য। অথচ হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে মিথ্যা হাদিস বলার ব্যাপারে কঠোর ধমকি ও শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে।

সহিহ বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে :
عَلِيًّا، يَقُولُ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لاَ تَكْذِبُوا عَلَيَّ، فَإِنَّهُ مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ فَلْيَلِجِ النَّارَ
‘আলি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা আমার ওপর মিথ্যারোপ কোরো না। কেননা, যে ব্যক্তি আমার ওপর মিথ্যরোপ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (সহিহুল বুখারি : ১/৩৩, হা. নং ১০৬, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)

সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে :
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا، فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ
‘আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আমার ওপর মিথ্যারোপ করবে সে তার ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নিল।’ (সহিহু মুসলিম : ১/১০, হা. নং ৩, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)

খ. মিলাদ মাহফিলগুলো সাধারণত রাত্রিকালীন হওয়ায় মানুষের ঘুম, ইবাদত ইত্যাদির ব্যাঘাত সৃষ্টি; এমনকি সারারাত এতে অংশগ্রহণ করায় অনেকবার ফজরের সালাত পর্যন্ত ছুটে যায়। অথচ ইসলামে মানুষকে অযথা কষ্ট দিতে নিষেধ করা হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَالَّذِينَ يُؤْذُونَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ بِغَيْرِ مَا اكْتَسَبُوا فَقَدِ احْتَمَلُوا بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُبِينًا
‘আর যারা বিনা অপরাধে মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের কষ্ট দেয়, তারা অপবাদ ও স্পষ্ট পাপের বোঝা বহন করে।’ (সুরা আল-আহজাব : ৫৮)

সহিহ বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে :
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: المُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ المُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ
‘আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, প্রকৃত মুসলিম তো সেই, যার মুখ ও হাত থেকে সকল মুসলিম নিরাপদ থাকে।’ (সহিহুল বুখারি : ১/১১, হা. নং ১০, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)

গ. মিলাদে অংশগ্রহন আবশ্যক মনে করা হয়, কেউ না করলে তাকে অপমান ও নবির দুশন ইত্যাদি বলে গালিগালাজ করা হয়। অথচ শরিয়তে বৈধ বা মুসতাহাব কাজে বাড়াবাড়ি করলে কিংবা কাজটিকে আবশ্যক মনে করলে তা বিদআতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। সাহাবায়ে কিরাম ঐচ্ছিক বিষয়কে আবশ্যক ভাবা শয়তানের চক্রান্ত ও ধোঁকা মনে করতেন।

সহিহ বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে :
عَنِ الأَسْوَدِ، قَالَ: قَالَ عَبْدُ اللَّهِ: لاَ يَجْعَلْ أَحَدُكُمْ لِلشَّيْطَانِ شَيْئًا مِنْ صَلاَتِهِ يَرَى أَنَّ حَقًّا عَلَيْهِ أَنْ لاَ يَنْصَرِفَ إِلَّا عَنْ يَمِينِهِ لَقَدْ رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَثِيرًا يَنْصَرِفُ عَنْ يَسَارِهِ
‘আসওয়াদ রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. বলেছেন, তোমাদের কেউ যেন স্বীয় সালাতের কোনো কিছু শয়তানের জন্য না বানায়। (তা হলো, ফরজ সালাতে সালাম ফেরানোর পর) সে কেবল ডান দিকে ফিরে বসাকে নিজের ওপর আবশ্যক মনে করে। অথচ আমি অনেক সময় নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বাম দিকে ফিরে বসতে দেখেছি।’ (সহিহুল বুখারি : ১/১৭০, হা. নং ৮৫২, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)

মুল্লা আলি কারি রহ. বলেন :
قَالَ الطِّيبِيُّ: وَفِيهِ أَنَّ مَنْ أَصَرَّ عَلَى أَمْرٍ مَنْدُوبٍ، وَجَعَلَهُ عَزْمًا، وَلَمْ يَعْمَلْ بِالرُّخْصَةِ فَقَدْ أَصَابَ مِنْهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْإِضْلَالِ
‘আল্লামা তিবি রহ. বলেন, এ হাদিস থেকে বুঝা যায়, যে ব্যক্তি কোনো মুসতাহাব বিষয়ের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে এবং সেটাকে আবশ্যক করে নেবে, তাহলে শয়তান তাকে গোমরাহিতে নিপতিত করল।’ (মিরকাতুল মাফাতিহ : ২/৭৫৫, প্রকাশনী : দারুল ফিকর, বৈরুত)

ঘ. রং-বেরঙের আলোকসজ্জা, সামিয়ানা, ডেকোরেশন, খাবারের আয়োজনসহ এতে প্রচুর পরিমাণে অপচয় ও অনর্থক খরচ হয়; অথচ ইসলামে অপচয় করাকে নিষিদ্ধ করে অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই বলে অভিহিত করা হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورًا
‘নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তান স্বীয় রবের প্রতি বড়ই অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৭)

ঙ. কুরআন-সুন্নাহর স্পষ্ট কোনো দলিল ছাড়াই নির্দিষ্টভাবে ১২ই রবিউল আওয়ালে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মবৃত্তান্ত আলোচনা করাকে অধিক সওয়াবের কারণ ও উত্তম মনে করা হয়; অথচ শরিয়তের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট না করা থাকলে না থাকলে কোনো দিবস বা সময়কে কোনো ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করা জায়িজ নয়।

সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে :
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: لَا تَخْتَصُّوا لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ بِقِيَامٍ مِنْ بَيْنِ اللَّيَالِي، وَلَا تَخُصُّوا يَوْمَ الْجُمُعَةِ بِصِيَامٍ مِنْ بَيْنِ الْأَيَّامِ، إِلَّا أَنْ يَكُونَ فِي صَوْمٍ يَصُومُهُ أَحَدُكُمْ
‘আবু হুরাইরা রা. সূত্রে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তোমরা রাতগুলোর মাঝে কেবল জুমআর রাতকেই রাতজাগার (অর্থাৎ তাহাজ্জুদ ও নফল সালাতের) জন্য নির্দিষ্ট কোরো না, আর দিনগুলোর মাঝে শুধু জুমআর দিনকেই সিয়ামের জন্য নির্ধারিত কোরো না। তবে দিনটি যদি তোমাদের কারও নিয়মতান্ত্রিক কোনো সিয়ামের দিনে পড়ে তাহলে ভিন্ন কথা।’ (সহিহু মুসলিম : ২/৮০১, হা. নং ১১৪৪, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)

চ. এতে বিভিন্ন বিদআতি কর্মকাণ্ড ও সহিহ আকিদা পরিপন্থী গান ও কবিতা আবৃতি করা হয়। এসব কর্মকাণ্ড ও কবিতা আবৃতির দ্বারা নিজেদের কানসুখ ও মনোরঞ্জন ছাড়া রাসুলের সিরাতের শিক্ষা ও তার বাস্তবায়ন -যেটা ছিল মূল লক্ষ্য- কখনো অর্জন হয় না।

ছ. অনেক জায়গায় এসব মাহফিল ও অনুষ্ঠানে নারী-পুরুষের অবাধ যাতায়াতের সুযোগ থাকে। আর এর কারণে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান পর্দা লঙ্ঘন হয়।

জ. মিলাদে কিয়াম করতে হয়, যা শরিয়া অনুমোদিত নয়। পাশাপাশি এতে নবিকে হাজির-নাজির মনে করা, আলিমুল গাইব বলাসহ অনেক শিরকি আকিদাও জড়িত থাকে।

ঝ. মিলাদ কিয়াম মৌখিকভাবে মুসতাহাব বললেও কাজে কর্মে কেউ মিলাদ কিয়াম না করলে তাকে ভর্ৎসনা করা হয় ও বাঁকা দৃষ্টিতে দেখা হয়।

ঞ. মিলাদ মাহফিলে হাদিস দ্বারা প্রমাণিত সহিহ দরুদ পাঠ না করে নিজেদের বানানো দরুদ পাঠ করা হয়।

এছাড়াও এতে আরও নানারকম রুসুম-রেওয়াজ বিদ্যমান, যা প্রচলিত ইদে মিলাদুন্নবি পালন বিদআত হওয়াকে সুনিশ্চিত করে। এজন্যই যুগে যুগে বিজ্ঞ উলামায়ে কিরাম এটাকে গর্হিত বিদআত আখ্যা দিয়ে আসছেন। আল্লাহ আমাদের সব ধরনের বিদআত ও রুসুম পালন থেকে দূরে রাখুন।

মিলাদুন্নবির পক্ষের দলিলাদি ও তার খণ্ডন

১ নং দলিল :
আল্লাহ তাআলা বলেন :
قُلْ بِفَضْلِ اللّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُواْ
‘আপনি বলুন, এটা (এসেছে) আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতে। অতএব, তারা যেন এতে আনন্দিত হয়। (সুরা ইউনুস : ৫৮)
উক্ত আয়াতে ‘রহমত’ দ্বারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদ্দেশ্য। যেহেতু অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে ‘রহমত’ বলে অভিহিত করেছেন, সুতরাং এখানেও ‘রহমত’ দ্বারা আল্লাহর রাসুলই উদ্দেশ্য হবেন। এরপর উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা এর কারণে খুশি উদযাপন করতে বলেছেন। আর মিলাদ মাহফিলের মাধ্যমে তো সেই খুশিই প্রকাশ করা হয়। তাই এটা বিদআত হওয়ার প্রশ্নই আসে না; বরং এটা হলো কুরআনি নির্দেশনা। যারা এটা অস্বীকার করবে, তারা কুরআনবিরোধী, তারা রিসালাহবিরোধী, তারা আল্লাহ ও তাঁর নবির দুশমন।

খণ্ডন :
প্রথমত, এ আয়াত দ্বারা তাদের দলিল দেওয়াই ভুল। কেননা, আয়াতে উদ্ধৃত ‘রহমত’ দ্বারা যদি নিশ্চিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদ্দেশ্য হতেন, তাহলে নাহয় একটা কথা ছিল, কিন্তু এটা তো মতানৈক্যপূর্ণ একটি বিষয়। এ আয়াতে ‘রহমত’ দ্বারা নবি উদ্দেশ্য নাকি অন্য কিছু, সে ব্যাপারে মুফাসসিরদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। উম্মাহর শ্রেষ্ঠ মুফাসসির ইবনে আব্বাস রা., এছাড়াও আবু সাইদ খুদরি রা., আনাস রা. বারা রা.-সহ অধিকাংশ সাহাবি ও তাবিয়ি মুফাসসিরদের মত হলো, এখানে ‘রহমত’ দ্বারা নবি উদ্দেশ্য নয়; বরং ইসলাম, ইমান বা কুরআন উদ্দেশ্য।

ইমাম কুরতুবি রহ. বলেন :
قَوْلُهُ تَعَالَى: (قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ) قَالَ أَبُو سَعِيدٍ الْخُدْرِيُّ وَابْنُ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا: فَضْلُ اللَّهِ الْقُرْآنُ، وَرَحْمَتُهُ الْإِسْلَامُ. وَعَنْهُمَا أَيْضًا: فَضْلُ اللَّهِ الْقُرْآنُ، وَرَحْمَتُهُ أَنْ جَعَلَكُمْ مِنْ أَهْلِهِ. وَعَنِ الْحَسَنِ وَالضَّحَّاكِ وَمُجَاهِدٍ وَقَتَادَةَ: فَضْلُ اللَّهِ الْإِيمَانُ، وَرَحْمَتُهُ الْقُرْآنُ، عَلَى الْعَكْسِ مِنَ الْقَوْلِ الْأَوَّلِ. وَقِيلَ: غَيْرُ هَذَا.
‘আল্লাহ তাআলার বাণী “আপনি বলুন, এটা (এসেছে) আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতে” : আবু সাইদ খুদরি রা. ও ইবনে আব্বাস রা. বলেন, আল্লাহর অনুগ্রহ হলো ইমান, আর তাঁর রহমত হলো ইসলাম। তাঁদের দুজন থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহর অনুগ্রহ হলো কুরআন, আর তাঁর রহমত হলো, তোমাদেরকে কুরআনের অনুসারী বানানো। আর প্রথম মতের উল্টো হাসান বসরি রহ., জাহহাক রহ., মুজাহিদ রহ. ও কাতাদা রহ. থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহর অনুগ্রহ হলো ইমান, আর তাঁর রহমত হলো কুরআন। এছাড়াও এতে আরও কিছু মত আছে।’ (তাফসিরুল কুরতুবি : ৮/৩৫৩, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল মিসরিয়্যা, কায়রো)

ইমাম তাবারি রহ. আয়াতটির অর্থ করেছেন :
يَقُولُ تَعَالَى ذِكْرُهُ لِنَبِيِّهِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: {قُلْ} يَا مُحَمَّدُ لِهَؤُلَاءِ المكذِّبين بِكَ وَبِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ عِنْدِ رَبِّكَ: {بِفَضْلِ اللَّهِ} أَيُّهَا النَّاسُ الَّذِي تَفَضَّلَ بِهِ عَلَيْكُمْ، وَهُوَ الْإِسْلَامُ، فَبَيَّنَهُ لَكَمْ وَدَعَاكُمْ إِلَيْهِ، {وَبِرَحْمَتِهِ} الَّتِي رَحِمَكُمْ بِهَا، فَأَنْزَلَهَا إِلَيْكُمْ، فَعَلَّمَكُمْ مَا لَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُونَ مِنْ كِتَابِهِ، وَبَصَّرَكُمْ بِهَا مَعَالِمَ دِينِكُمْ؛ وَذَلِكَ الْقُرْآنُ.
‘আল্লাহ তাআলা তাঁর নবিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “বলুন” হে মুহাম্মাদ, ওইসব লোকদের উদ্দেশ্যে, যারা আপনাকে ও আপনার রবের পক্ষ থেকে যা নাজিলকৃত অহিকে অস্বীকার করে, হে লোকসকল, “আল্লাহর অনুগ্রহে” যদ্বারা তিনি তোমাদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন, আর সেটা হলো ইসলাম। সুতরাং তিনি তোমাদেরকে স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন এবং সেদিকে তোমাদের আহবান করেছেন। আর “তাঁর রহমতে” যদ্বারা তিনি তোমাদের ওপর দয়া করেছেন, এরপর তোমাদের প্রতি রহমত নাজিল করেছেন, অতঃপর তোমরা যা জানতে না, তোমাদের সেই কিতাব শিক্ষা দিয়েছেন এবং তোমাদের দ্বীনের রূপরেখা ও পথ দেখিয়েছেন, আর সেটা হলো কুরআন।’ (তাফসিরুত তাবারি : ১৫/১০৫, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)

দ্বিতীয়ত, কিছু মুফাসসিরদের মত অনুযায়ী রহমত দ্বারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদ্দেশ্য হলেও কোনো অসুবিধা নেই। কেননা, এতে আনন্দিত হওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু প্রকাশ করা বা এর পদ্ধতি নিয়ে কিছু বলা হয়নি। অথচ আমাদের আলোচ্যবিষয় আনন্দিত হওয়া নিয়ে নয়; বরং প্রচলিত নিয়মে আনন্দ প্রকাশ করার ধরণ নিয়ে। তাই এ আয়াত দ্বারা প্রচলিত নিয়মের মিলাদকে প্রমাণ করার কোনো অবকাশ নেই।

তৃতীয়ত, বিদআতিদের ভাষ্যনুসারে এ আয়াতের দ্বারা যদি প্রচলিত মিলাদ সাব্যস্ত করাই হয়, তাহলে তো দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা মিলে সারামাস ও সারাবছরই মিলাদ পালন করা উচিত। কেননা, এখানে মিলাদের মাধ্যমে খুশি প্রকাশ করা হচ্ছে মালুল (معلول) বা বিধান, আর তার ইল্লত (علة) বা কারণ হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অস্থিত। নিয়ম হলো, ইল্লত বিদ্যমান থাকলে তার মালুল বা বিধানও বহাল থাকবে। সুতরাং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মের পর থেকে যেহেতু তিনি অস্থিত্বলাভ করেছেন এবং এখনও তাঁর অস্তিত্ব বহাল আছে, বিধায় সর্বদাই তার মালুল তথা মিলাদ পালন করাটাও সাব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। যদি কেউ বলে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ইনতিকালের পর তো দুনিয়াতে তাঁর অস্তিত্ব নেই, তাই সর্বদা করার কোনো প্রয়োজন নেই, তাহলে আমরা উত্তরে বলব, আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের সর্বসম্মত আকিদা হলো, আম্বিয়ায়ে কিরাম সবাই স্ব স্ব কবরে জীবিত আছেন। সুতরাং নিজেদের বাতিল মতের ওপর উত্থাপিত আপত্তি থেকে বাঁচতে তাঁকে অস্তিত্বহীন বলাটা নবির শানে মারাত্মক বেআদবি, যা আশেকে রাসুল দাবিদারদের সাথে কিছুতেই মানানসই নয়। দ্বিতীয়ত, যদি তাঁকে দুনিয়ার জীবনে মৃত্যু হয়েছে বিধায় অস্তিত্বহীন বলে, তাহলে আমরা বলব, সেক্ষেত্রে তোমাদের মিলাদ পালনেরও কোনো অধিকার নেই। কেননা, তাঁর অস্তিত্বের ভিত্তিতেই বিধান বলা হয়েছিল। সুতরাং যখন অস্তিত্বই নেই তখন বিধানও বাকি থাকবে না। মোটকথা এ আয়াত থেকে মিলাদ প্রমাণ করতে গেলে তাদের এ দুটির যেকোনো একটি মেনে নিতেই হবে—হয় সারাবছর মিলাদ পালন করবে, নয়তো একেবারেই করবে না। গোলমেলে উত্তর দিয়ে মাঝামাঝি থাকার কোনো সুযোগ নেই।

চতুর্থত, আয়াতে আমরের সিগা (নির্দেশসূচক ক্রিয়া) ব্যবহার করা হয়েছে, যা কাজকে বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া সম্বোধিত ব্যক্তির ওপর আবশ্যক করে দেয়। অথচ আমাদের জানামতে বিদআতি আলিমরা মিলাদুন্নবি পালনকে আবশ্যক বলে না; বরং তারাও এটাকে মুসতাহাব বা মুসতাহসান বলে। এ আয়াতে বিশেষ কোনো ব্যতিক্রম এর দলিল না থাকা সত্ত্বেও যখন কেউই মিলাদ পালনকে ওয়াজিব বা ফরজ বলেনি, বুঝা গেলো এখানে মিলাদের কথা বলা হয়নি। নতুবা আমরের সিগার নিয়মানুসারে তা আবশ্যক হয়ে যেত। সুতরাং এ আয়াত দ্বারা প্রচলিত মিলাদুন্নবি প্রমাণ করা ভুল, যাকে তারা মুসতাহাব বলে প্রচার করে। তবে কেউ যদি হঠকারিতা করে এ আয়াত থেকে মিলাদকে আবশ্যক বলে দেয়, তাহলে সে আরও বড় বিপদ ও আপত্তির মুখে পড়বে, যা আহলে ইলমদের অজানা নয়।

২ নং দলিল :
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَكُلا نَقُصُّ عَلَيْكَ مِنْ أَنْبَاءِ الرُّسُلِ مَا نُثَبِّتُ بِهِ فُؤَادَكَ وَجَاءَكَ فِي هَذِهِ الْحَقُّ وَمَوْعِظَةٌ وَذِكْرَى لِلْمُؤْمِنِينَ
‘আর রাসুলদের সব ঘটনা আমি আপনার কাছে বলছি, যদ্বারা আমি আপনার অন্তর সুদৃঢ় করছি। আর এরই মাধ্যমে আপনার কাছে এসেছে সত্য আর মুমিনদের জন্য স্মারকপত্র।’ (সুরা হুদ : ১২০)

এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা জানিয়েছেন যে,পূর্ববতী নবিদের ঘটনা বর্ণনার দ্বারা রাসুলের আধ্যাতিক দৃঢ়তা অর্জন হয় এবং মুমিনদের উপদেশও শিক্ষা লাভ হয়। সুতরাং মিলাদুন্নবিতে যেহেতু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবনী ও ঘটনা আলোচনার মাধ্যমে মুমিনদের অন্তরে দৃঢ়তা সৃষ্টি হয় এবং উপদেশ লাভ হয়; বিধায় এ আয়াত দ্বারা স্পষ্টভাবে মিলাদুন্নবি সাব্যস্ত হয়।

খণ্ডন :
প্রথমত, এখানে সব ধরনের ঘটনা বর্ণনা করা উদ্দেশ্য নয়; বরং যেসব ঘটনা বললে অন্তরের দৃঢ়তা অর্জন হয় শুধু সেগুলোর বর্ণনাই উদ্দেশ্য। আর তা হলো দ্বীন ও দাওয়াতের কাজ করতে গিয়ে নবিগণ যেসব অবর্ণনীয় কষ্ট ও ধৈর্যের সম্মুখীন হয়েছেন তার বিবরণ। আর এগুলো তো নবুওয়াতের পরেই হয়ে থাকে, আগে নয়। মিলাদ যেহেতু নবুওয়াতপূর্ব ঘটনাবলীর আলোচনাকে বলে; বিধায় প্রতীয়মান হলো যে, এটা মিলাদসংক্রান্ত কোনো আয়াত নয়, যার ভিত্তিতে মিলাদুন্নবি প্রমাণ হবে।

আল্লাহ তাআলা এ আয়াতটির পূর্বে যেসব ঘটনা বর্ণনা করেছেন, তা ছিল সব দাওয়াতি কষ্ট ও সহিঞ্চুতার আলোচনা, জন্মসংক্রান্ত আলোচনা নয়। আর কোনো মজলিসে আম্বিয়ায়ে কিরামের এসব কষ্ট ধৈর্যের আলোচনা করা হলে সেটাকে তো কেউ মিলাদুন্নবির মাহফিল বলেনা। সুতরাং এ আয়াতটিও মিলাদুন্নবির পক্ষে দলিল হতে পারে না।

দ্বিতীয়ত, এ আয়াতে প্রচলিত পদ্ধতিতে মিলাদের ব্যাপারে সামান্য ইঙ্গিতও দেওয়া হয়নি। অথচ প্রচার করা হচ্ছে, এ আয়াতটি তাদের মিলাদুন্নবি প্রমাণের পক্ষে বড় একটি দলিল। নিজেদের মনগড়া পদ্ধতিকে এভাবে অপ্রাসঙ্গিক আয়াত দিয়ে প্রমাণ দেওয়ার কথা বলে মানুষকে ধোঁকা দেওয়া তাদের চরম নীচুতা ও হীনমন্যতাই প্রমাণ করে। এটা কুরআনের স্পষ্ট অপব্যাখ্যা, হাদিসে যার পরিণতি বলা হয়েছে জাহান্নাম। আল্লাহ আমাদের কুরআনের অপব্যাখ্যা থেকে রক্ষা করুন।

৩ নং দলিল :
আল্লাহ তাআলা বলেন :
لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ
‘তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসুল এসেছেন। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তার জন্যও কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের কল্যাণকামী এবং মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল ও দয়ালু।’ (সুরা আত-তাওবা : ১২৮)

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সংক্ষিপ্ত বিলাদাত বা জন্মকাহিনী এবং আমাদের প্রতি তার দয়া-দাক্ষিণ্যের আলোচনা করেছেন। আমরা যেহেতু মিলাদুন্নবি মাহফিলের মজলিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মবৃত্তান্ত ও দয়া-দাক্ষিণ্যের আলোচনাই করে থাকি তাই উক্ত আয়াত আমাদের পালিত মিলাদুন্নবির পক্ষে বড় একটি দলিল।

খণ্ডন :
প্রথমত, উপরিউক্ত আয়াতে মূলত جاء (এসেছেন) শব্দকে ولد (জন্মগ্রহণ করেছেন) অর্থ ধরেই বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা নিজেই নবির জন্মকাহিনী আলোচনা করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, না আরবি ভাষায় جاء শব্দের এমন কোনো অর্থ পাওয়া যায়, আর না কোনো নির্ভরযোগ্য মুফাসসির শব্দটির এমন অর্থ করেছেন। বস্তুত এখানে جاء অর্থ জন্মগ্রহণ করা নয়;বরং নবুওয়াতপ্রাপ্তি উদ্দেশ্য।

কুরআনের অনেক আয়াতেই جاء শব্দটি নবুওয়াতপ্রাপ্তি অর্থের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। তন্মধ্য থেকে আমরা কতিপয় আয়াত এখানে উল্লেখ করছি। যথা :
وَلَقَدْ جَاءَكُمْ مُوسَى بِالْبَيِّنَاتِ ثُمَّ اتَّخَذْتُمُ الْعِجْلَ مِنْ بَعْدِهِ وَأَنْتُمْ ظَالِمُونَ
‘নিশ্চয়ই মুসা তোমাদের কাছে স্পষ্ট প্রমাণসহ এসেছিলেন। অতঃপর তাঁর অনুপস্থিতে তোমরা গো-বৎসকে (উপাস্য হিসেবে) গ্রহণ করেছিলে।’ (সুরা আল-বাকারা : ৯২)

وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ النَّبِيِّينَ لَمَا آتَيْتُكُمْ مِنْ كِتَابٍ وَحِكْمَةٍ ثُمَّ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مُصَدِّقٌ لِمَا مَعَكُمْ لَتُؤْمِنُنَّ بِهِ وَلَتَنْصُرُنَّهُ
‘আর (স্মরণ করুন,) যখন আল্লাহ নবিদের থেকে অঙ্গিকার গ্রহণ করলেন যে, আমি তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমাহ যা কিছু দিয়েছি, অতঃপর তোমাদের কাছে যা আছে, তার সত্যায়নকারীরূপে যখন একজন রাসুল আসবে, তখন তোমরা অবশ্যই তার প্রতি ইমান আনবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে।’ (সুরা আলি ইমরান : ৮১)

يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَكُمُ الرَّسُولُ بِالْحَقِّ مِنْ رَبِّكُمْ فَآمِنُوا خَيْرًا لَكُمْ
‘হে লোকসকল, রাসুল তো তোমাদের কাছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে সত্য নিয়ে এসেছেন; সুতরাং তোমরা ইমান আনো, তাহলে তোমাদের কল্যাণ হবে।’ (সুরা আন-নিসা : ১৭০)

يَا أَهْلَ الْكِتَابِ قَدْ جَاءَكُمْ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمْ عَلَى فَتْرَةٍ مِنَ الرُّسُلِ أَنْ تَقُولُوا مَا جَاءَنَا مِنْ بَشِيرٍ وَلا نَذِيرٍ فَقَدْ جَاءَكُمْ بَشِيرٌ وَنَذِيرٌ وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
‘হে কিতাবিরা, তোমাদের কাছে আমার রাসুল এসেছেন, যিনি রাসুলদের আগমনিধারায় একটি বিরতির পর সবকিছু বুঝিয়ে দিচ্ছেন; না হলে তোমরা বলতে, আমাদের কাছে কোনো সুসংবাদদাতা কিংবা সতর্ককারী আসেনি। সেজন্যই তোমাদের কাছে একজন সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী এসেছেন। আর আল্লাহ সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান। (সুরা আল-মায়িদা : ১৯)

সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলেও বুঝা যায়, এসব আয়াতে রাসুলের আগমন বলতে তাঁর জন্ম বুঝানো হয়নি; বরং তাদের নবুওয়াতপ্রাপ্তি বুঝানো হয়েছে, যা মুফাসসিরগণ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। এ ধরনের আরও অনেক আয়াতেই جاء শব্দটি নবুওয়াতপ্রাপ্তির অর্থে ব্যবহার হয়েছে, জন্মগ্রহণের অর্থে নয়।

দ্বিতীয়ত, এ আয়াত নাজিল হয়েছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবনের শেষ বয়সে। আর শেষ বয়সে এসে ‘তোমাদের মাঝে একজন রাসুল জন্মগ্রহণ করেছে’ বলাটা বড় অদ্ভুদ ব্যাপার! এমন কথা সমগ্র জাহানের অধিপতি মহান আল্লাহ থেকে কল্পনাও করা যায় না!! তাই এ আয়াতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম নিয়ে আলোচনা করার দাবিটি সম্পূর্ণরূপে ভুল।

তৃতীয়ত, কুরআনে কোনো বাক্য অনর্থক বলা হয়নি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম হওয়ার বিষয়টি যেহেতু সুস্পষ্ট একটি বিষয়, যাতে কারও কোনোরূপ সন্দেহ নেই, বিধায় কুরআনে তাঁর জন্ম হয়েছে বলাটা অপ্রয়োজনীয়। পক্ষান্তরে কাফিররা যেহেতু তার রাসুল হওয়াকে অস্বীকার করেছে, বিধায় আল্লাহ তাআলা এ আয়াত দ্বারা তার রাসুল হওয়ার স্বীকৃতি দিয়ে কাফিরদের কথাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাই এটিকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মসংক্রান্ত আয়াত বলা যাবে না।

চতুর্থত, جاء সহ তার সমজাতীয় সকল শব্দের فاعل বা কর্তা হিসেবে ‘রাসুল’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে ‘মুহাম্মাদ’ শব্দ নয়। এতেও পরিষ্কার ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, এখানে রিসালাত ও নবুওয়াতপ্রাপ্তির অর্থই উদ্দেশ্য, জন্মগ্রহণের অর্থ নয়।

৪ নং দলিল :
আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّ اللَّهَ وَمَلائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর নবির ওপর রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতারা তাঁর জন্য দুআ-ইসতিগফার করেন। অতএব, হে ইমানদারগণ, তোমরাও তাঁর সালাত (দরুদ) পাঠ করো এবং তাঁকে যথাযথভাবে সালাম জানাও।’ (সুরা আল-আহজাব : ৫৬)

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওপর দরুদ পড়তে বলেছেন। আর মিলাদুন্নবিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো দরুদই পড়া হয়। সুতরাং এ আয়াত দ্বারাও মিলাদুন্নবির পক্ষে শক্তিশালী প্রমাণ পাওয়া যায়।

খণ্ডন :
প্রথমত, বর্তমান প্রচলিত মিলাদুন্নবির মাহফিলগুলোতে দরুদ পড়া হয় খুবই সামান্য সময়। তাও আবার সঠিক নিয়মে হাদিসে বর্ণিত দরুদ নয়; বরং আরেকটি বিদআতি কর্ম কিয়ামের সাথেসাথে নিজেদের বানানো দরুদ পড়া হয়।

দ্বিতীয়ত, উক্ত আয়াতে দরুদ ও সালাম পড়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে, মিলাদুন্নবি পালন বা রাসুলের জন্মকাহিনী বলার আদেশ নয়। মিলাদুন্নবিতে তো দরুদ পড়া হয় প্রাসঙ্গিকভাবে সামান্য সময়। এখানে মূল আলোচ্য বিষয়ই থাকে রাসুলের জীবনী ও সিরাত। তাহলে উক্ত আয়াত দ্বারা মিলাদুন্নবির পক্ষে দলিল দেওয়া কিভাবে শুদ্ধ হয়?

তৃতীয়ত, কোথাও মিলাদুন্নবির অনুষ্ঠানে দরুদ পড়া মুখ্য হলেও প্রচলিত নিয়মে একসাথে একত্রিত হয়ে দরুদ পড়ার এমন কোনো পদ্ধতি যেহেতু আয়াতে বলা হয়নি, কোনো মুফাসসিরও এমন ব্যাখ্যা লিখেননি এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কোনো সাহাবি থেকেও এরূপ কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না বিধায় উক্ত আয়াত দ্বারা মিলাদুন্নবি সাব্যস্ত হবে না।

৫ নং দলিল :
আল্লাহ তাআলা বলেন :

رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيهِمْ رَسُولا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيهِمْ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
‘হে আমাদের রব, আর আপনি তাদের (আমাদের বংশধরদের) মধ্যে তাদের থেকেই একজন রাসুল প্রেরণ করুন, যিনি তাদেরকে আপনার আয়াতসমূহ পাঠ করে শোনাবে, তাদেরকে কিতাব ও হিকমাহ শিক্ষা দেবে এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবে। নিশ্চয়ই আপনি মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা আল বাকারা : ১২৯)

وَإِذْ قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَمُبَشِّرًا بِرَسُولٍ يَأْتِي مِنْ بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ فَلَمَّا جَاءَهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ قَالُوا هَذَا سِحْرٌ مُبِينٌ
‘(স্মরণ করুন,) যখন মরিয়মের পুত্র ইসা বলেছিল, হে বনি ইসরাইল, আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর প্রেরিত রাসুল (দূত)। আমার পূর্ববর্তী তাওরাতের আমি সত্যায়নকারী এবং আমি এমন একজনের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আগমন করবেন। তাঁর নাম হবে আহমাদ। অতঃপর তিনি যখন স্পষ্ট প্রমাণাদি নিয়ে আসলেন, তখন তারা বলল, এ তো প্রকাশ্য জাদু! (সুরা আস-সফ : ৬)

إِذْ قَالَتِ امْرَأَةُ عِمْرَانَ رَبِّ إِنِّي نَذَرْتُ لَكَ مَا فِي بَطْنِي مُحَرَّرًا فَتَقَبَّلْ مِنِّي إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ. فَلَمَّا وَضَعَتْهَا قَالَتْ رَبِّ إِنِّي وَضَعْتُهَا أُنْثَى وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا وَضَعَتْ وَلَيْسَ الذَّكَرُ كَالأنْثَى وَإِنِّي سَمَّيْتُهَا مَرْيَمَ وَإِنِّي أُعِيذُهَا بِكَ وَذُرِّيَّتَهَا مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ.
‘(স্মরণ করুন,) যখন ইমরানের স্ত্রী বলল, হে আমার রব, আমার গর্ভে যে সন্তান রয়েছে, আমি তাকে একান্তভাবে আপনার জন্য উৎসর্গ করলাম। আমার পক্ষ থেকে আপনি তা গ্রহণ করুন। নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা মহাজ্ঞানী। অতঃপর সে যখন তাকে প্রসব করল, তখন বরল, হে আমার রব, আমি তো কন্যা প্রসব করেছি। বস্তুত সে যা প্রসব করেছে, আল্লাহ তা ভালো করেই জানেন। আর পুত্রসন্তান কন্যাসন্তানের মতো নয়। আমি তার নাম রেখেছি মরিয়ম। আর আমি তাকে ও তাঁর সন্তানদেরকে অভিশপ্ত শয়তানের প্রভাব থেকে (রক্ষার জন্য) আপনার আশ্রয়ে সমর্পণ করছি।’ (সুরা আলি ইমরান : ৩৫)

فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلامٍ حَلِيمٍ
‘অতঃপর আমি তাকে সুসংবাদ দিলাম ধৈর্যশীল এক সন্তানের।’ (সুরা আস-সফফাত : ১০১)

يَا زَكَرِيَّا إِنَّا نُبَشِّرُكَ بِغُلامٍ اسْمُهُ يَحْيَى لَمْ نَجْعَلْ لَهُ مِنْ قَبْلُ سَمِيًّا. قَالَ رَبِّ أَنَّى يَكُونُ لِي غُلامٌ وَكَانَتِ امْرَأَتِي عَاقِرًا وَقَدْ بَلَغْتُ مِنَ الْكِبَرِ عِتِيًّا. قَالَ كَذَلِكَ قَالَ رَبُّكَ هُوَ عَلَيَّ هَيِّنٌ وَقَدْ خَلَقْتُكَ مِنْ قَبْلُ وَلَمْ تَكُ شَيْئًا.
‘হে জাকারিয়া, আমি তোমাকে একটি পুত্রের সুসংবাদ দিচ্ছি। তার নাম ইয়াহইয়া। এর আগে তার নামে কারও নামকরণ করিনি। সে বলল, হে আমার রব, আমার পুত্র হবে কীভাবে? আমার স্ত্রী তো বন্ধ্যা। আর আমিও তো একেবারে বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছি। তিনি বললেন, এরূপই হবে। তোমার পালনকর্তা বলছেন, এটা আমার পক্ষে সহজ। এর আগে আমি তোমাকেও তো সৃষ্টি করেছি, যখন তুমি কিছুই ছিলে না।’ (সুরা মারইয়াম : ৭-৯)

وَأَوْحَيْنَا إِلَى أُمِّ مُوسَى أَنْ أَرْضِعِيهِ فَإِذَا خِفْتِ عَلَيْهِ فَأَلْقِيهِ فِي الْيَمِّ وَلا تَخَافِي وَلا تَحْزَنِي إِنَّا رَادُّوهُ إِلَيْكِ وَجَاعِلُوهُ مِنَ الْمُرْسَلِينَ
‘আর আমি মুসার মায়ের কাছে আদেশ পাঠালাম, তাকে বুকের দুধ পান করাও। অতঃপর যখন তা বিপদের আশঙ্কা করবে, তখন তাকে নদীতে ফেলে দেবে। ভয় কোরো না, দুঃখ কোরো না। আমি তাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেবো এবং তাকে একজন রাসুল বানাব।’ (সুরা আল-কাসাস : ৭)

এসব আয়াতে বিভিন্ন নবির বংশ ও জন্ম-মৃত্যুর কথা আলোচনা করা হয়েছে। আর আমাদের মিলাদুন্নবির মাহফিলগুলোতে তো এসব আলোচনাই করা হয়। সুতরাং এসব আয়াতের দ্বারা মিলাদুন্নবি স্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়।

খণ্ডন :
প্রথম আয়াতে আমাদের নবির নসব বা জন্মবৃত্তান্ত কিছুই বলা হয়নি, শুধু নবুওয়াতকালে তাঁর দায়িত্ব ও কাজ কেমন হবে তা বলা হয়েছে। আর অন্যান্য আয়াতে যেসব নবিদের জন্মবৃত্তান্ত আলোচনা করা হয়েছে, সামান্য একটু লক্ষ্য করলে স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হবে যে, তা সাধারণ ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করা হয়নি; বরং সবই ছিল আল্লাহ বিশেষ কুদরতের বহিঃপ্রকাশ। যেমন ইসা আ. পিতাবিহীন জন্মলাভ করা। মুসা আ. চরম প্রতিকুল পরিবেশে জন্মলাভ করা। ইয়াহইয়া আ., ইসমাইল আ. ও ইসহাক আ.-এর জন্ম তাঁদের পিতার চরম বার্ধক্যকালে হওয়া ইত্যাদি। পক্ষান্তরে, আমাদের নবির জন্ম যেহেতু স্বাভাবিক নিয়মে হয়েছে এজন্য তাঁর জন্মের আলোচনা কুরআনের কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। অতএব, এসব আয়াত দ্বারা প্রচলিত মিলাদুন্নবি প্রমাণ করা শুধু ভুলই নয়; বরং চরম ইলমি দৈন্যতা ও অজ্ঞতার পরিচয় বহন করে।

৬ নং দলিল :
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَاذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ
‘আর তোমাদের প্রতি আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্মরণ করো।’ (সুরা আল-বাকারা : ২৩১)

এখানে নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে বলা হয়েছে। আর পৃথিবীতে আমাদের জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন সবচেয়ে বড় নিয়ামত। তাই আনুষ্ঠানিক মিলাদুন্নবির মাধ্যমে আমরা সে নিয়ামতেরই শুকরিয়া আদায় করি।

খণ্ডন :
এগুলো সব মনগড়া তাফসির, যার সাথে না আছে কুরআনের সম্পর্ক, না হাদিসের আর না বিজ্ঞ মুফাসসিরিনে কিরামের মতামতের। বস্তুত এসব আয়াতে নিয়ামত বলতে ইমান ও হিদায়াতের নিয়ামত এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নবুওয়াতপ্রাপ্তি উদ্দেশ্য; যেমনটি মুফাসসিরিনে কিরাম উল্লেখ করেছেন।

ইমাম বাগাবি রহ. বলেন :
{وَاذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ} بِالْإِيمَانِ
‘“আর তোমাদের প্রতি আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্মরণ করো।” অর্থাৎ ইমানের নিয়ামত।’ (তাফসিরুল বাগাবি : ১/২৭৫, প্রকাশনী : দারু তাইয়িবা, বৈরুত)

ইমাম বাইজাবি রহ. বলেন :
وَاذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ التي من جملتها الهداية، وبعثة محمد صلّى الله عليه وسلّم
‘“আর তোমাদের প্রতি আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্মরণ করো।” তার নিয়ামতের মধ্য হতে অন্যতম হলো, হিদায়াত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নবুওয়াতপ্রাপ্তি। (তাফসিরুল বাইজাবি : ১/১৪৩, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)

ইমাম তাবারি রহ. বলেন :
وَاذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ بِالْإِسْلَامِ، الَّذِي أَنْعَمَ عَلَيْكُمْ بِهِ، فَهَدَاكُمْ لَهُ
‘“আর তোমাদের প্রতি আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্মরণ করো।” অর্থাৎ ইসলামের নিয়ামত, যা তিনি তোমাদের দান করেছেন এবং তোমাদেরকে সেদিকে পথপ্রদর্শন করেছেন।’ (তাফসিরুত তাবারি : ৫/১৫, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)

ইমাম ইবনে কাসির রহ. বলেন :
وَاذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ، أَيْ فِي إِرْسَالِهِ الرَّسُولَ بِالْهُدَى وَالْبَيِّنَاتِ إِلَيْكُمْ
‘“আর তোমাদের প্রতি আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্মরণ করো।” অর্থাৎ (শুকরিয়া আদায় করো) তোমাদের নিকট রাসুলকে হিদায়াত ও প্রমাণাদি সহকারে প্রেরণ করায়।’ (তাফসিরু ইবনি কাসির : ১/৪৭৬, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)

সুতরাং আয়াতে ‘নিয়ামত’ বলতে হিদায়াত, ইসলাম, রাসুলের নবুওয়াতপ্রাপ্তি বা রাসুল প্রেরণ যেটাই হোক না কেন, এতে কোনোভাবেই প্রচলিত পদ্ধতির মিলাদুন্নবি প্রমাণ হয় না। কেননা, এখানে اذكروا দ্বারা উদ্দেশ্য এসব নিয়ামতের জন্য আনুগত্যের মাধ্যমে শুকরিয়া জ্ঞাপন এবং এ নিয়ামতের যথাযথ হক আদায় করা।

আল্লামা আলুসি রহ. বলেন :
وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ أي قابلوها بالشكر والقيام بحقوقها
‘“আর তোমাদের প্রতি আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্মরণ করো।” অর্থাৎ তোমরা এসব নিয়ামতের মোকবিলায় শুকর জ্ঞাপন করো এবং শুকরিয়ার হক আদায় করো।’ (রুহুল মাআনি : ১/৫৩৭, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)

মোটকথা, এ আয়াতে শুকরিয়ার মাধ্যমে তাঁর নিয়ামত বর্ণনা করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। আর আহলে ইলমদের এটা জানা আছে যে, শুকরিয়া সাধারণত কর্মের দ্বারা করা হয়, মুখের দ্বারা নয়। আর কর্মের মাধ্যমে শুকরিয়া একমাত্র সুন্নাতে নববিকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমেই অর্জন হবে, সিন্নি, জিলাপি আর বৎসরের একদিন কেবল মৌখিক ভালোবাসা প্রকাশের মাধ্যমে নয়।

৭ নং দলিল :
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ
‘আর আপনি আপনার রবের নিয়ামতের কথা বর্ণনা করুন।’ (সুরা আজ-জুহা : ১১)

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা নিয়ামতের আলোচনা করার আদেশ দিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই যেহেতু এক বড় নিয়ামত; সুতরাং মিলাদুন্নবির মাধ্যমে তাঁর আলোচনা করে এ আয়াতের ওপর আমল করা হয়। অতএব, এ আয়াত দ্বারাও মিলাদুন্নবি সাব্যস্ত হয়।

খণ্ডন :
এক্ষেত্রে পূর্বোক্ত আলোচনা দ্রষ্টব্য। পাশাপাশি এ আয়াতে নিয়ামতের বর্ণনা করার আদেশ সর্বপ্রথম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং তিনি এ আয়াতের ওপর আমল করতে গিয়ে যেহেতু মিলাদুন্নবি পালন করেননি, অনুরূপ তাঁর প্রাণপ্রিয় সাহাবিগণও জীবনে এ পদ্ধতিতে আমল করেননি; বিধায় পরবর্তী সময়ে এসে আমরা কিভাবে উক্ত আয়াতের ওপর আমল করতে গিয়ে মিলাদুন্নবি পালন করতে পারি? এ আয়াত দ্বারা প্রচলিত পদ্ধতিতে মিলাদুন্নবি পালন সাব্যস্ত হলে তো এ আয়াতের ওপর প্রথমে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে, এরপর তাঁর সাহাবায়ে কিরামই আমল করতেন। তাঁদের থেকে যখন এমন কোনো আমলের প্রমাণ নেই, বুঝা যায়, বিদআতিরা এ আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা করছে, যার কোনো প্রমাণ শরিয়তে পাওয়া যায় না।

৮ নং দলিল :
ইমাম তিরমিজি রহ. বর্ণনা করেন :
عَنِ الْمُطَّلِبِ بْنِ عَبْدِ اللهِ بْنِ قَيْسِ بْنِ مَخْرَمَةَ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ، قَالَ: وُلِدْتُ أَنَا وَرَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَامَ الفِيلِ، قَالَ: وَسَأَلَ عُثْمَانُ بْنُ عَفَّانَ قُبَاثَ بْنَ أَشْيَمَ أَخَا بَنِي يَعْمَرَبْنِ لَيْثٍ: أَنْتَ أَكْبَرُ أَمْ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ فَقَالَ: رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَكْبَرُ مِنِّي وَأَنَا أَقْدَمُ مِنْهُ فِي الْمِيلاَدِ، ولد رسول الله صلى الله عليه و سلم عام الفيل ورفعت بي أمي على الموضع قَالَ: وَرَأَيْتُ خَذْقَ الْفِيلِ أَخْضَرَ مُحِيلاً.
‘কাইস বিন মাখরামা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হস্তিবাহিনীর ঘটনার বছর জন্মগ্রহণ করেছি। বর্ণনাকারী বলেন, উসমান বিন আফফান রা. ইয়াসার বিন লাইস গোত্রীয় কুবাস বিন আশইয়ামকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি বড় নাকি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম? তিনি বললেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (মর্যাদার দিক থেকে) আমার চাইতে অনেক বড়। তবে জন্মের দিক থেকে আমি তাঁর চেয়ে অধিক বয়স্ক। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হস্তিবাহিনীর ঘটনার বছর জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, আর আমার মা আমাকে এমন জায়গায় নিয়ে গেলেন, যেখানে গিয়ে আমি হাতিগুলোর মলের রং সবুজে বদল হয়ে যেতে দেখেছি।’ (সুনানুত তিরমিজি : ৬/১৮, হা. নং ৩৬১৯, প্রকাশনী : দারুল গারবিল ইসলামি, বৈরুত)

এ থেকে প্রমাণ হয় যে, সাহাবায়ে কিরাম রা. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মকাহিনী নিয়ে পরস্পরে আলোচনা করতেন। আর জন্মকাহিনী নিয়ে আলোচনার নামই যেহেতু মিলাদুন্নবি; বিধায় এর দ্বারা সাহাবাযুগে মিলাদুন্নবির অস্তিত্ব প্রমাণ হলো।

খণ্ডন :
সামান্য বিবেক আছে, এমন যে কেউই বুঝবে যে, এটা ছিল ইতিহাসসংক্রান্ত ইলমি একটি জিজ্ঞাসা ও তার উত্তর। প্রচলিত নিয়মে এটা কোনো মিলাদুন্নবির মাহফিল ছিল না; বরং একবারই ঘটনাচক্রে কাইস বিন মাখরামা রা. নিজের সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মের সম্পর্কের বিষয়টি বর্ণনা করেছেন। আর কারও জন্মসালে বিখ্যাত কারও জন্ম হওয়া এবং গর্ব করে তা অপরকে বলা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার । সুতরাং এর সাথে বর্তমান মিলাদুন্নবির ন্যূনতম কোনো সম্পর্ক নেই।

৯ নং দলিল :
ইমাম তিরমিজি রহ. বর্ণনা করেন :
عَنِ الْمُطَّلِبِ بْنِ أَبِي وَدَاعَةَ، قَالَ: جَاءَ العَبَّاسُ، إِلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَكَأَنَّهُ سَمِعَ شَيْئًا، فَقَامَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى الْمِنْبَرِ فَقَالَ: مَنْ أَنَا؟، فَقَالُوا: أَنْتَ رَسُولُ اللهِ عَلَيْكَ السَّلاَمُ. قَالَ: أَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ، إِنَّ اللَّهَ خَلَقَ الخَلْقَ فَجَعَلَنِي فِي خَيْرِهِمْ فِرْقَةً، ثُمَّ جَعَلَهُمْ فِرْقَتَيْنِ فَجَعَلَنِي فِي خَيْرِهِمْ فِرْقَةً، ثُمَّ جَعَلَهُمْ قَبَائِلَ، فَجَعَلَنِي فِي خَيْرِهِمْ قَبِيلَةً، ثُمَّ جَعَلَهُمْ بُيُوتًا فَجَعَلَنِي فِي خَيْرِهِمْ بَيْتًا وَخَيْرِهِمْ نَسَبًا.
‘মুত্তালিব বিন আবু অদাআ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আব্বাস রা. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকটে এলেন। সম্ভবত তিনি কিছু শুনতে পেয়ে মিম্বরে আরোহন করলেন। অতঃপর বললেন, আমি কে? সাহাবিগণ বললেন, আপনি আল্লাহর রাসুল। আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। তিনি বললেন, আমি মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল মুত্তালিব। আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিকুলকে সৃষ্টি করে আমাকে উত্তম অংশের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এরপর তাদেরকে দুভাগে বিভক্ত করে আমাকে উত্তম দলের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অতঃপর তাদেরকে বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত করে আমাকে উত্তম গোত্রের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অতঃপর তাদেরকে বিভিন্ন পরিবারে বিভক্ত করে আমাকে উত্তম পরিবার ও উত্তম বংশের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।’ (সুনানুত তিরমিজি : ৫/৪৩৩, হা. নং ৩৫৩২, প্রকাশনী : দারুল গারবিল ইসলামি, বৈরুত)

এ হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের বংশমর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা বর্ণনা করেছেন। বুঝা গেল, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগেও মিলাদ বা তাঁর জন্মবৃত্তান্তের আলোচনা ছিল। সুতরাং মিলাদুন্নবিকে বিদআত বলা যাবে না।

খণ্ডন :
প্রথমত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্মবৃত্তান্ত শুনানোর জন্য মজলিস কায়েম করেননি; বরং সমালোচনার জবাব দেওয়ার জন্য নিজের বংশ পরিচয় পরিষ্কার করে বর্ণনা করেছেন। আর এ ধরনের মজলিস রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবনে দ্বিতীয়বার হওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। সুতরাং এটা মিলাদুন্নবির পক্ষে দলিল হতে পারে না।

দ্বিতীয়ত, এ ঘটনায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সমালোচনার জবাব দেওয়া আবশ্যক ছিল। পক্ষান্তরে মিলাদপন্থীরা যে মিলাদুন্নবি পালন করে, সেটাকে তারা আবশ্যক মনে করে না; বরং মুসতাহাব মনে করে। সুতরাং ওয়াজিব আমলের দ্বারা মুসতাহাব আমলের প্রমাণ দেওয়া সঠিক নয়।

তৃতীয়ত, উপরোক্ত হাদিসে মিলাদপন্থীদের দাবি অনুপাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্যিই যদি মিলাদুন্নবি করে থাকেন তাহলে লক্ষ্য করুন তার ধরণ ছিল-অনির্দিষ্টভাবে, অল্পসময়ে, সমালোচনার জবাবে, মসজিদের ভিতরে, জীবনে একবার, সবাইকে না জানিয়ে, ডাকাডাকি ছাড়া, কিয়াম ছাড়া, তাবারক বিতরণ ছাড়া।

সুতরাং উপরিউক্ত নিয়মে কেউ যদি মিলাদ পালন করতে চায় তাহলে এতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু বর্তমান প্রচলিত মিলাদ কি এভাবেই হয়ে থাকে? বিষয়টি পাঠকদের কারও অজানা নয়। সুতরাং এ হাদিস দ্বারা প্রচলিত মিলাদের পক্ষে দলিল দেওয়া সম্পূর্ণরূপে ভুল।

১০ নং দলিল :
ইমাম বাইহাকি রহ. বর্ণনা করেন :
عَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ , أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَقَّ عَنْ نَفْسِهِ بَعْدَ النُّبُوَّةِ
‘আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াতের পর নিজের পক্ষ থেকে আকিকা করেছেন।’ (আস-সুনানুল কুবরা, বাইহাকি : ৯/৫০৫, হা. নং ১৯২৭৩, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)

এ হাদিস থেকে জানা যায় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আকিকা তারা দাদা করা সত্ত্বেও নবুওয়াতপ্রাপ্তির পর শুকরিয়া হিসেবে দ্বিতীয়বার আকিকা করেছেন। যেহেতু তাঁর জন্ম উম্মতের জন্য হিদায়াত ও নাজাতের অসিলা, তাই তিনি এর শুকরিয়া স্বরূপ নিজের আকিকা পুনরায় করেন। সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, তাঁর জন্ম উপলক্ষে খানা খাওয়ারো, দান-সদকা করা, ইবাদত করা ইত্যাদি ভালো কাজ।

খণ্ডন :
প্রথমত, এ হাদিসটি প্রমাণঅযোগ্য দুর্বল, যা ইমাম বাইহাকি রহ. নিজেই হাদিসটি বর্ণনা করার পর ইমাম আব্দুর রাজ্জাক রহ.-এর উদ্ধৃতিতে উল্লেখ করেছেন। অতএব, এ হাদিস দ্বারা কোনো ধরনের প্রমাণ দেওয়ার অবকাশ নেই।

দ্বিতীয়ত, দাবি করা হয়েছে যে, তিনি এটা তাঁর জন্মের শুকরিয়া স্বরূপ আকিকা করেছেন। অথচ হাদিসে শুধু আকিকার কথা বলা হয়েছে, শুকরিয়ার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। যদি এটা জন্মের শুকরিয়া হিসেবেই করা হতো, তাহলে তো প্রতি বৎসরই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটা করতেন এবং তাঁর প্রাণপ্রিয় সাহাবিগণ তো অবশ্যই করতেন। কিন্তু এসংক্রান্ত কোনো বর্ণনা নেই যে, তাঁরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্য আকিকা করেছেন।

তৃতীয়ত, নবুওয়াতের পর তাঁর এ আকিকা দ্বারা তার জন্মদিবস পালন বা শুকরিয়া আদায় উদ্দেশ্য ছিল না। মূল বিষয় হলো, আকিকা যেহেতু ইবাদত, আর কোনো অমুসলিমের দ্বারা ইবাদত আদায় হয় না; তাই তাঁর দাদা কর্তৃক আকিকা দেওয়া সত্ত্বেও পরে সামর্থ্য হওয়ায় নিজে পুনরায় সহিহ পন্থায় তা আদায় করেন।

উল্লেখ্য যে, বিয়েশাদি মুআমালার অন্তর্ভুক্ত, সরাসরি ইবাদত নয়। এজন্য বিবাহ মুসলিম-অমুসলিম সবার ক্ষেত্রে বরাবর। সুতরাং নবুওয়াত পরবর্তী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিবাহ নবায়নের কোনো প্রয়োজন ছিল না। পক্ষান্তরে আকিকা সম্পূর্ণরূপে ইবাদত, যা একমাত্র আল্লাহর জন্যই করা হয়ে থাকে। অতএব, মুশরিকের আকিকা আদায় সহিহ হয় না, কিন্তু তার বিবাহ সহিহ বলে গণ্য করা হয়।

১১ নং দলিল :
বুখারির তালিকে বর্নিত হয়েছে :
قَالَ [ص:10] عُرْوَةُ، وثُوَيْبَةُ مَوْلاَةٌ لِأَبِي لَهَبٍ: كَانَ أَبُو لَهَبٍ أَعْتَقَهَا، فَأَرْضَعَتِ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَلَمَّا مَاتَ أَبُو لَهَبٍ أُرِيَهُ بَعْضُ أَهْلِهِ بِشَرِّ حِيبَةٍ، قَالَ لَهُ: مَاذَا لَقِيتَ؟ قَالَ أَبُو لَهَبٍ: لَمْ أَلْقَ بَعْدَكُمْ غَيْرَ أَنِّي سُقِيتُ فِي هَذِهِ بِعَتَاقَتِي ثُوَيْبَةَ
‘উরওয়াহ রহ. বর্ণনা করেন, সুওয়াইবা ছিল আবু লাহাবের দাসি এবং সে তাকে আজাদ করে দিয়েছিল। এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে দুধ পান করায়। আবু লাহাব যখন মারা গেল, তখন তার একজন আত্মীয় তাকে স্বপ্নে দেখল, সে ভীষণ কষ্টের মধ্যে আছে। তাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা হয়েছে? আবু লাহাব বলল, যখন থেকে তোমাদের থেকে আসার পর আমি ভীষণ কষ্টে আছি। কিন্তু সুওয়াইবাকে আজাদ করার কারণে কিছু পানি পান করতে পারছি।’ (সহিহুল বুখারি : ৭/৯, হা. নং ৫১০১, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)

এতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মগ্রহণে আনন্দ প্রকাশ করার প্রতিদান স্বরূপ আবু লাহাব যদি জাহান্নামে যাওয়া সত্ত্বেও এর কিছু প্রতিদান পেয়ে থাকে, তাহলে কোনো মুমিন বান্দা করলে যে আরও বেশি প্রতিদান ও সওয়াবের উপযুক্ত হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মিলাদুন্নবির মাহফিল তো মূলত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মের খুশিতে আনন্দ প্রকাশ ছাড়া অন্য কিছু নয়। অতএব, এ হাদিস থেকে মিলাদুন্নবির প্রামাণ্যতা সাব্যস্ত হয়।

খণ্ডন :
প্রথমত, আবুল লাহাব তার বাদিকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মের খুশির ভিত্তিতে আজাদ করেছিল কিনা, এটাই বিতর্কিত। অধিকাংশ সিরাত লেখকদের মতে আবু লাহাব রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মের সময় নয়; বরং পরবর্তী কালে হিজরতের কিছু পূর্বে বা পরে আজাদ করেছিল।

হাফিজে হাদিস ইবনে হাজার আসকালানি রহ. বলেন :
قَوْلُهُ وَكَانَ أَبُو لَهَبٍ أَعْتَقَهَا فَأَرْضَعَتِ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ظَاهِرُهُ أَنَّ عِتْقَهُ لَهَا كَانَ قَبْلَ إِرْضَاعِهَا وَالَّذِي فِي السِّيَرِ يُخَالِفُهُ وَهُوَ أَنَّ أَبَا لَهَبٍ أَعْتَقَهَا قَبْلَ الْهِجْرَةِ وَذَلِكَ بَعْدَ الْإِرْضَاعِ بِدَهْرٍ طَوِيلٍ
‘হাদিসের উক্তি “আবু লাহাব তাকে আজাদ করে দিয়েছিল। এরপর সে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে দুধ পান করায়।” এ থেকে বাহ্যত বুঝা যায়, আবু লাহাব তাকে দুধ পান করানোর আগেই আজাদ করে দিয়েছিল। কিন্তু সিরাত গ্রন্থসমূহের বর্ণনা এর সাথে সাংঘর্ষিক। তাতে আছে যে, আবু লাহাব তাকে হিজরতের কিছুকাল পূর্বে আজাদ করেছিল। আর সেটা ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে দুধ পান করানোর দীর্ঘদিন পরের ঘটনা।’ (ফাতহুল বারি : ৯/১৪৫, প্রকাশনী : দারুল মারিফা, বৈরুত)

সুতরাং এ ঘটনা দ্বারা মিলাদুন্নবির বৈধতা বা প্রামাণ্যতা কিছুতেই সাব্যস্ত হয় না।

দ্বিতীয়ত, যদি এটা মেনেও নেয়া হয় যে, সে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মের সময় বাদি আজাদ করেছিল তাহলেও এতে মিলাদুন্নবি সাব্যস্ত হয় না। কেননা, সে -রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্ম গ্রহণ করেছেন- এটা ভেবে আজাদ করেনি; বরং তার ভাতিজা হওয়ার খুশিতে বাদি আজাদ করেছে। যদি সে নবির আগমণের কারণেই খুশি হতো তাহলে সে পরবর্তীকালে অবশ্যই ইমান আনত। পরকালে সে কিছুটা সুবিধা পাচ্ছে নবির জন্মের খুশিতে তার বাদি আজাদ করার কারণে নয়; বরং নির্বিঘ্নে তার এতিম শিশুভাতিজার লালন-পালনের জন্য দয়া পরবশ হয়ে আজাদ কারণে। তিনি নবি হবেন সেটা তো স্বয়ং আল্লাহর রাসুল নিজেই জানতেন না, সেখানে আর আবু লাহাবের জানার তো প্রশ্নই না। তবে সে কাফির হলেও দাস-দাসি আজাদ করাও যেহেতু পূণ্যের কাজ ছিল, তাই সে এর কিছুটা প্রতিদান পাবে। সুতরাং আবু লাহাবের খুশির সাথে প্রচলিত মিলাদুন্নবির খুশির কোনো মিল বা সামঞ্জস্যতা নেই।

তৃতীয়ত, প্রথম সংবাদ পাওয়াকে সুসংবাদ বলে। আর এর পরের সংবাদকে সাধারণ সংবাদ বলে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম আবুল লাহাব প্রথমে জানতে পেরেছিল বিধায় সেটা ছিল সুসংবাদ। আর তাই সে খুশি হয়ে বাদি আজাদ করেছিল। আমরা তো শুধু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মের সংবাদ পেয়েছি; সুসংবাদ নয়। সুতরাং আবু লাহাবের খুশির সাথে আমাদের খুশি হওয়ার মাঝে অনেক ব্যবধান রয়েছে। তাছাড়াও কারও জন্মের পর মৃত্যু হলে তার জন্মসংবাদ আর সুসংবাদ থাকে না; বরং সেটা হয় দুঃসংবাদ ও বেদনার বার্তা। কেননা, সে তো গত হয়ে গেছে। জন্মের সুসংবাদ একমাত্র জীবিতদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

১২ নং দলিল :
সহিহ বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে :
صحيح البخاري (5/ 70)
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَالَ: لَمَّا قَدِمَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ المَدِينَةَ وَجَدَ اليَهُودَ يَصُومُونَ عَاشُورَاءَ، فَسُئِلُوا عَنْ ذَلِكَ، فَقَالُوا: هَذَا اليَوْمُ الَّذِي أَظْفَرَ اللَّهُ فِيهِ مُوسَى، وَبَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَى فِرْعَوْنَ، وَنَحْنُ نَصُومُهُ تَعْظِيمًا لَهُ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: نَحْنُ أَوْلَى بِمُوسَى مِنْكُمْ، ثُمَّ أَمَرَ بِصَوْمِهِ
‘ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদিনায় আসলেন, তখন দেখতে পেলেন ইহুদিরা আশুরা দিবসে সাওম পালন করে। তাদেরকে সাওম পালনের কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, এদিনে আল্লাহ তাআলা মুসা আ. ও বনি ইসরাইলকে ফিরাউনের ওপর বিজয় দান করেছিলেন। তাই আমরা ওইদিনের সম্মানে সাওম পালন করি। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমাদের চেয়ে আমরাই মুসা আ.-এর অধিক নিকটবর্তী। এরপর তিনি সাওম পালনের নির্দেশ দিলেন।’ (সহিহুল বুখারি : ৫/৭০, হা. নং ৩৯৪৩, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)

উক্ত হাদিস থেকে প্রতিয়মান হয় যে, বিশেষ কোনো দিনকে কৃতজ্ঞতা আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট করে তাতে কোনো ইবাদত করা শরিয়া অনুমোদিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মতারিখ যেহেতু বিশেষ এক দিবস, তাই এর শুকরিয়া স্বরূপ উক্ত দিনে খুশি প্রকাশ ও দান-সদকা করে মানুষকে খানা খাওয়ানো ও মিলাদ পালন করা উত্তম কাজ বলে সাব্যস্ত হবে।

খণ্ডন :
প্রথমত, যদি ইসলামে নির্দিষ্ট দিবস পালনের নিমিত্তে বিশেষ ইবাদতের পদ্ধতি বের করা হয় তাহলে তো ইসলামের বিশেষ দিবস অনেক রয়েছে। যেমন নবুওয়াতপ্রাপ্তি দিবস, বদর যুদ্ধে বিজয় দিবস, উহুদ যুদ্ধে শত্রু থেকে পরিত্রাণ দিবস, মক্কাবিজয় দিবস, বিদায় হজ্বের দিবস। এভাবে বড় বড় নিয়ামতের তালিকা করলে শত শত দিসব বের হবে। তাহলে দেখা যাবে, বছরের অধিকাংশ দিনেই বিশেষ কোনো পদ্ধতিতে ইবাদত চালু হয়ে বিদআতের নতুন দ্বার খুলে যাবে। অথচ কেউই এমনটার প্রবক্তা নয়।

দ্বিতীয়ত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম অবশ্যই খুশির এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এ খুশি উদযাপনের নিয়ম তো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই বাতলে দিয়েছেন।

সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে :
عَنْ أَبِي قَتَادَةَ الْأَنْصَارِيِّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ… وَسُئِلَ عَنْ صَوْمِ يَوْمِ الِاثْنَيْنِ؟ قَالَ: ذَاكَ يَوْمٌ وُلِدْتُ فِيهِ، وَيَوْمٌ بُعِثْتُ – أَوْ أُنْزِلَ عَلَيَّ فِيهِ
‘আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, …আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে সোমবারে সিয়াম রাখার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, এদিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং এদিনেই আমার ওপর অহি নাজিল হয়েছে।’ (সহিহু মুসলিম : ২/৮১৯, হা. নং ১১৬২, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)

এতে স্পষ্টভাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মের কৃতজ্ঞতা কিভাবে আদায় করবে, তার বিবরণ দেওয়া আছে। কিন্তু তা বাদ দিয়ে নতুন পন্থা আবিষ্কার করা প্রকারন্তরে তাঁর সুন্নাতকেই অবজ্ঞার শামিল। মিলাদুন্নবির এ বিদআতি এ প্রথার কারণেই সম্ভবত আমাদের মাঝ থেকে সোমবারে রোজা রাখার গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাতটি বিদায় নিয়েছে। বস্তুত সুন্নাতের জায়গায় বিদআত আসলে সে সুন্নাত চিরবিদায় নিয়ে চলে যায়।

যেমন মুসনাদে দারিমিতে বর্ণিত হয়েছে :
عَنْ حَسَّانَ، قَالَ: مَا ابْتَدَعَ قَوْمٌ بِدْعَةً فِي دِينِهِمْ إِلَّا نَزَعَ اللَّهُ مِنْ سُنَّتِهِمْ مِثْلَهَا ثُمَّ لَا يُعِيدُهَا إِلَيْهِمْ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ

‘হাসসান রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কোনো জাতি দ্বীনের মধ্যে কোনো বিদআত চালু করলে আল্লাহ তাদের থেকে ওই জাতীয় একটি সুন্নাত উঠিয়ে নেন, যা কিয়ামত পর্যন্ত আর তাদের মাঝে ফিরিয়ে দেন না। (সুনানুদ দারিমি : ১/২৩১, হা. নং ৯৯, প্রকাশনী : দারুল মুগনি, সৌদিআরব)

এতে প্রতিয়মান হয় যে, মিলাদুন্নবি পালনের প্রতি আমাদের এ অঞ্চলের লোকদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হওয়ায় সোমবারে সিয়াম রাখার এ সুন্নাতটি আমাদের থেকে একেবারে ছুটে গিয়েছে। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন।

তৃতীয়ত, আশুরার হাদিসের ওপর ভিত্তি করে যেহেতু কোনো সাহাবি বা মুজতাহিদ ইজতিহাদ করে বিশেষ দিবস পালনের বৈধতা দেননি; বিধায় পরবর্তী সময়ে আমরা যারা মুজতাহিদ নই, তাদের কারও জন্য এতে নতুন করে ইজতিহাদ করার অধিকার নেই।

১৩ নং দলিল :
মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে :
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُودٍ، قَالَ:… فَمَا رَأَى الْمُسْلِمُونَ حَسَنًا، فَهُوَ عِنْدَ اللهِ حَسَنٌ.
‘আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, …সুতরাং মুসলিমরা যেটাকে ভালো মনে করবে, আল্লাহর নিকট সেটা ভালো বলে বিবেচিত হবে। (মুসনাদু আহমাদ : ৬/৮৪, হা. নং ৩৬০০, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)

এ হাদিস থেকে প্রমাণ হয়, মুসলমানরা কোনো একটি কাজকে ভালো মনে করলে সেটা আল্লাহর নিকটও ভালো বলে গণ্য হয়। সুতরাং মিলাদুন্নবিকে যেহেতু আওলিয়ায়ে কিরামসহ অনেক মুসলমান ভালো ও উত্তম কাজ মনে করে, তাই এটা বিদআত হতে পারে না; বরং উক্ত হাদিস অনুসারে এটা উত্তম কাজ বলে বিবেচিত হবে।

খণ্ডন :
প্রথমত, উক্ত বর্ণনাটি মারফু (রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উক্তি) নয়; বরং মাওকুফ (সাহাবির উক্তি) হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। যেমন আল্লামা জামালুদ্দিন জাইলায়ি রহ. বলেন :

قَالَ عليه السلام: “مَا رَآهُ الْمُسْلِمُونَ حَسَنًا فَهُوَ عِنْدَ اللَّهِ حَسَنٌ”، قُلْت: غَرِيبٌ مَرْفُوعًا، وَلَمْ أَجِدْهُ إلَّا مَوْقُوفًا عَلَى ابْنِ مَسْعُودٍ،
‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মুসলিমরা যেটাকে ভালো মনে করবে, আল্লাহর নিকট সেটা ভালো বলে বিবেচিত হবে। আমি বলব, মারফু হিসেবে এটা দুর্বল। আমি এটাকে ইবনে মাসউদ রা. থেকে শুধু মাওকুফ সূত্রেই পেয়েছি। (নাসবুর রায়া : ৪/১৩৩, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রাইয়ান, বৈরুত)

দ্বিতীয়ত, المسلمون এর মধ্যে الف ولام টি عهد خارجى এর জন্য হয়েছে। অর্থাৎ এখানে শুধু নির্দিষ্ট কিছু মুসলমান উদ্দেশ্য। আর তাঁরা হলেন সাহাবায়ে কিরাম রা.। ইবনে মাসউদ রা. এর পূর্ণ বর্ণনাটি পড়লে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

তিনি বলেন :
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُودٍ، قَالَ: إِنَّ اللهَ نَظَرَ فِي قُلُوبِ الْعِبَادِ، فَوَجَدَ قَلْبَ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَيْرَ قُلُوبِ الْعِبَادِ، فَاصْطَفَاهُ لِنَفْسِهِ، فَابْتَعَثَهُ بِرِسَالَتِهِ، ثُمَّ نَظَرَ فِي قُلُوبِ الْعِبَادِ بَعْدَ قَلْبِ مُحَمَّدٍ، فَوَجَدَ قُلُوبَ أَصْحَابِهِ خَيْرَ قُلُوبِ الْعِبَادِ، فَجَعَلَهُمْ وُزَرَاءَ نَبِيِّهِ، يُقَاتِلُونَ عَلَى دِينِهِ، فَمَا رَأَى الْمُسْلِمُونَ حَسَنًا، فَهُوَ عِنْدَ اللهِ حَسَنٌ، وَمَا رَأَوْا سَيِّئًا فَهُوَ عِنْدَ اللهِ سَيِّئٌ
‘আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের অন্তরের দিকে নজর দিয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্তরকে সবচেয়ে উত্তম হৃদয়ের অধিকারী হিসেবে পেলেন। অতঃপর তাঁকে নিজের জন্য বাছাই করে নিলেন। এরপর তাঁকে রিসালাত দিয়ে প্রেরণ করলেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অন্তর দেখার পর পুনরায় তিনি বান্দাদের অন্তরের দিকে নজর দিলেন। তখন তাঁর সাহাবিদের অন্তর সবচেয়ে উত্তম হিসেবে পেলেন। অতঃপর তাঁদেরকে তাঁর নবির সাথী হিসেবে নির্বাচন করলেন, যারা তাঁর দ্বীনের জন্য লড়াই করে। সুতরাং (এ ধরনের) মুসলিমরা যেটাকে ভালো মনে করবে, আল্লাহর নিকট সেটা ভালো বলে বিবেচিত হবে। আর যেটাকে তাঁরা মন্দ হিসেবে দেখবে, সেটা আল্লাহর নিকট মন্দ বলে গণ্য হবে। (মুসনাদু আহমাদ : ৬/৮৪, হা. নং ৩৬০০, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)

এতে فمارأىالمسلمون বাক্যে فاء শব্দটি তার পরবর্তী হুকুমের শুরুতে প্রবেশ করেছে। যেমন উসুলে ফিকহে বলা হয়েছে :
والأصل أن تدخل الفاء على الأحكام لتأخرها عن العلل
‘মূলনীতি হলো, فاء শব্দটি হুকুমসমূহের শুরুতে আসবে। যেহেতু হুকুমগুলো ইল্লতের পরেই আসে। (ইফাজাতুল আনওয়ার : পৃ. নং ১২০)

সুতরাং فاء এর পরের বাক্যটি এমন একটি ইল্লত বা কার্যকারণের হুকুম হবে, যা فاء এর পূর্বে আছে। আর এখানে فاء এর পূর্বে রয়েছে, كون الصحابة وزراء نبيه وأنصار دينه باختيار الله (অর্থাৎ, আল্লাহর বাছাইয়ের ভিত্তিতে সাহাবায়ে কিরাম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথি ও তাঁর সাহায্যকারী হওয়া) কথাটি। বিধায় এ ইল্লত পাওয়া গেলে তবেই তা ভালো কাজ বলে বিবেচিত হবে। সারাংশ দাঁড়ায়, সাহাবায়ে কিরাম আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্য নির্বাচিত সাথী হওয়ায় তাদের মাঝে দ্বীনের প্রতি পূর্ণ দায়িত্ববোধ, ভালোবাসা ও হিতাকাঙ্খা রয়েছে। বিধায় এমন লোকেরা যে কাজটিকে ভালো মনে করবে তা আল্লাহর নিকট ভালো কাজ বলে বিবেচিত হবে। বুঝা গেল, এখানে যেকোনো ধরনের মুসলমান উদ্দেশ্য নয়; বরং বিশেষ নির্বাচিত লোকজন উদ্দেশ্য। তাই এ হাদিস দ্বারা নিজেদের মনগড়া মিলাদুন্নবির বৈধতা প্রমাণ করা পুরোপুরিই ভুল।

তৃতীয়ত, المسلمون এর الف لام কে استغراقى (সামগ্রিকতার অর্থসম্পন্ন) বলা যায়। যেহেতু جمع বা বহুবচনের শুরুতে الف لام আসলে তা استغراقى এর অর্থে আসে। সুতরাং হাদিসটির অর্থ হবে, সকল মুসলমান সম্মিলিতভাবে যে কাজটিকে ভালো মনে করবে সেটা আল্লাহর নিকট ভালো। অর্থাৎ এখানে ইজমার কথা বুঝানো হচ্ছে। এ ব্যাখানুপাতে প্রচলিত মিলাদ প্রমাণিত হয় না। কেননা, মিলাদুন্নবিকে সকল মুসলমান ঐক্যবদ্ধভাবে ভালো মনে করে না; বরং উল্টো অধিকাংশ মুসলমান এটাকে গর্হিত ও বিদআত মনে করে।

মিলাদুন্নবির বিপক্ষের দলিলাদি :
১ নং দলিল :
সহিহ বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে :
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيهِ، فَهُوَ رَدٌّ
‘আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের এ দ্বীনের মধ্যে এমন বিষয় আবিষ্কার করবে, যা দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত নয়, তাহলে সেটা প্রত্যাখ্যাত।’ (সহিহুল বুখারি : ৩/১৮৪, হা. নং ২৬৯৭, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)

এ হাদিস থেকে প্রতিয়মান হয় যে,দ্বীন বিষয়ক কোনো পন্থা, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যার অনুমোদন দেননি, তা প্রত্যাখ্যাত। যেহেতু বর্তমানে প্রচলিত মিলাদুন্নবি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে; এমনকি তার পরবর্তী সোনালী যুগেও বিদ্যমান ছিল না এবং এর কোনো ভিত্তিও পাওয়া যায়নি; বিধায় তা দ্বীনের মধ্যে সংযোজনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় প্রত্যাখ্যাত হবে।

প্রচলিত মিলাদুন্নবি বিদআত হবে কিনা তা নির্ভর করছে বিদআতের সংজ্ঞার ওপর। তাই আমরা প্রথমে সংক্ষিপ্তাকারে বিদআতের সংজ্ঞা উল্লেখ করছি। বিদআতের সংজ্ঞা নিয়ে একাধিক মত পাওয়া যায়। যথা :
ক. ইমাম নববি রহ. বলেন :
الْبِدْعَةُ كُلُّ شَيْءٍ عُمِلَ عَلَى غَيْرِ مِثَالٍ سَبَقَ، وَفِي الشَّرْعِ إِحْدَاثُ مَا لَمْ يَكُنْ فِي عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
‘বিদআত বলা হয়, প্রত্যেক এমন বস্তুকে, যা পূর্বের কোনো দৃষ্টান্ত ছাড়া করা হয়। আর শরয়ি পরিভাষায় বিদআত হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে যার কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়নি।’ (মিরকাতুল মাফাতিহ : ১/২২৩, প্রকাশনী : দারুল ফিকর, বৈরুত)

আল্লামা বদরুদ্দিন আইনি রহ.-ও অনুরূপ বলেন :
والبدعة لُغَة: كل شَيْء عمل عَليّ غير مِثَال سَابق، وَشرعا إِحْدَاث مَا لم يكن لَهُ أصل فِي عهد رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم
‘আভিধানিক অর্থে বিদআত বলা হয়, প্রত্যেক এমন বস্তুকে, যা পূর্বের কোনো দৃষ্টান্ত ছাড়া করা হয়। আর শরয়ি পরিভাষায় বিদআত বলা হয়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে যার কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়নি।’ (উমদাতুল কারি : ৫/২৩০, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)

মূলত এ সংজ্ঞাটি পূর্ণাঙ্গ হয়নি। কেননা, এতে নব আবিষ্কৃত যেকোনো জিনিসকে বিদআত বলা হয়েছে; অথচ শরয়ি পরিভাষায় সকল নবআবিস্কৃত জিনিসকেই বিদআত বলা হয় না। শুধুমাত্র দ্বীন ও ইবাদতসংক্রান্ত হলেই কেবল তা বিদআত হতে পারে, অন্য কিছু নয়। তবে এ সংজ্ঞায় العبادة من (ইবাদত জাতীয়) কথাটি ঊহ্য মানলে সেক্ষেত্রে তা শরয়ি বিদআতের সংজ্ঞা হতে পারে।

খ. ইমাম শাতিবি রহ. বলেন :
طَرِيقَةٍ فِي الدِّينِ مُخْتَرَعَةٍ، تُضَاهِي الشَّرْعِيَّةَ، يُقْصَدُ بِالسُّلُوكِ عَلَيْهَا الْمُبَالَغَةُ فِي التَّعَبُّدِ لِلَّهِ سُبْحَانَهُ
‘বিদআত হলো ধর্মের নামে এমন আবিষ্কৃত পন্থা, যা শরিয়তের সাথে সাদৃশ্য রাখে, (শরিয়তের সীমার বাহিরে) অতিরিক্ত গুরুত্বের সহিত আল্লাহর ইবাদত করার উদ্দেশ্যেই এমন কাজ করা হয়ে থাকে।’ (আল-ইতিসাম : ১/৪৭, প্রকাশনী : দারু ইবনিল জাওজি, সৌদিআরব)

তিনি এর আরেকটি সংজ্ঞা বলেছেন এভাবে :
الْبِدْعَةُ طَرِيقَةٌ فِي الدِّينِ مُخْتَرَعَةٌ، تُضَاهِي الشَّرْعِيَّةَ، يُقْصَدُ بِالسُّلُوكِ عَلَيْهَا مَا يُقْصَدُ بِالطَّرِيقَةِ الشَّرْعِيَّةِ
‘বিদআত হলো দ্বীনের নামে এমন একটি আবিষ্কৃত পন্থা, যা শরিয়তের সাথে সাদৃশ্য রাখে, পাশাপাশি শরিয়ত পালনের দ্বারা যা উদ্দেশ্য (অর্থাৎ সওয়াব অর্জন), এখানেও সেটা উদ্দেশ্য হয়।’ (প্রাগুক্ত)

গ. আল্লামা শুমুন্নি রহ. বলেন :
مَا أُحْدِثَ عَلَى خِلَافِ الْحَقِّ الْمُتَلَقَّى عَنْ رَسُولِ اللَّهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ عِلْمٍ أَوْ عَمَلٍ أَوْ حَالٍ بِنَوْعِ شُبْهَةٍ وَاسْتِحْسَانٍ، وَجُعِلَ دَيْنًا قَوِيمًا وَصِرَاطًا مُسْتَقِيمًا
‘বিদআত বলা হয়, অস্পষ্ট দলিল বা ভালো মনে করার ভিত্তিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর থেকে প্রমাণিত সঠিক পন্থার বিপরীতে যে ইলম, আমল বা অবস্থা আবিষ্কৃত হয় এবং সেটাকে সুদৃঢ় দ্বীন ও সঠিক পথ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।’ (রদ্দুল মুহতার : ১/৫৬০-৫৬১, প্রকাশনী : দারুল ফিকর, বৈরুত)

উপরিক্ত দুটি সংজ্ঞা থেকে বুঝা যায়, শরিয়তের আলোকে কোনো জিনিস বিদআত হওয়ার জন্য নিন্মোক্ত শর্তগুলো থাকতে হবে। যথা :
ক. শরিয়তে তার কোনো ভিত্তি থাকতে পারবে না কিংবা শরিয়তের প্রতিষ্ঠিত কোনো বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হতে হবে।
খ. বাহ্যকভাবে শরিয়তের সাথে সাদৃশ্য থাকতে হবে।
গ. ইবাদত ও সওয়াবের কাজ মনে করে পালন করতে হবে।
ঘ. আবিষ্কৃত পদ্ধতিকে সঠিক ও উত্তম মনে করতে হবে।

বর্তমান প্রচলিত মিলাদুন্নবিতে উপরিউক্ত শর্তগুলো যথাযথরূপেই পাওয়া যায়। কারণ, শরিয়তে এ বিশেষ পদ্ধতির কোনো ভিত্তি তো নেই-ই; বরং তা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মদিন পালন অর্থাৎ, প্রতি সোমবারে সিয়াম রাখা নিয়মের সাথে সাংঘর্ষিকও বটে। পাশাপাশি বাহ্যিকভাবে তা ইবাদতের সঙ্গে সাদৃশ্য রাখে এবং ইবাদত মনে করে ও সওয়াবের আশায়ই করা হয়। আর এটাকেই সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের মাধ্যম মনে করা হয়। সঙ্গত কারণেই প্রচলিত মিলাদ বিদআতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

উল্লেখ্য যে, যে সকল জিনিস ইবাদতের সহায়ক হিসেবে আবিষ্কৃত হয়েছে, সরাসরি ইবাদত হিসেবে নয়, সেগুলোকে বিদআত বলা যাবে না। যেমন কুরআন-হাদিস বুঝার জন্য নাহু-সরফসহ বিভিন্ন শাস্ত্রের উৎপত্তি, কুরআনে হরকত সংযুক্তি, মাজহাব চতুষ্টয়ের উদ্ভাবন, তাবলিগ জামাআত ও মাদরাসার প্রচলন ইত্যাদি। এগুলো একটাও মুল ইবাদত তথা ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত বা মুসতাহাব হিসেবে করা হয় না; বরং ইবাদতের সহায়ক হিসেবে করা হয়। তাই এগুলো বিদআতের অন্তর্ভুক্ত করা হবে না।

২ নং দলিল :
আল্লাহ তাআলা বলেন :
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الإسْلامَ دِينًا
‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণ করলাম, তোমাদের জন্য আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং দ্বীন হিসেবে ইসলামকে তোমাদের জন্য পছন্দ করলাম।’ (সুরা আল-মায়িদা : ৩)

এ আয়াতে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর দ্বীন তথা ইসলামকে পূর্ণতা দান করেছেন। কিয়ামত পর্যন্ত এতে না কিছু বৃদ্ধি পাবে, না কোনো কিছু হ্রাস পাবে আর না কোনো কিছুর দিকে তাকে মুখাপেক্ষী হতে হবে।

আল্লামা ইবনে কাসির রহ.বলেন :
وَقَالَ عَلِيُّ بْنُ أَبِي طَلْحَةَ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَوْلَهُ الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَهُوَ الْإِسْلَامُ، أَخْبَرَ اللَّهُ نَبِيَّهُ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ والمؤمنين أنه قد أَكْمَلَ لَهُمُ الْإِيمَانَ، فَلَا يَحْتَاجُونَ إِلَى زِيَادَةٍ أبدا، أَتَمَّهُ اللَّهُ فَلَا يَنْقُصُهُ أَبَدًا، وَقَدْ رَضِيَهُ اللَّهُ فَلَا يَسْخَطُهُ أَبَدًا.
‘আলি বিন আবু তালহা রহ. ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আল্লাহর বাণী- “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণ করলাম” আর সেটা হলো ইসলাম। আল্লাহ তাআলা তাঁর নবি ও মুমিনদের জানাচ্ছেন যে, তিনি তাদের ইমান পূর্ণ করে দিয়েছেন; সুতরায় কখনো তাদের কোনো কিছু বৃদ্ধি করার প্রয়োজন হবে না। আল্লাহ এটাকে সম্পূর্ণ করেছেন; অতএব এতে কখনো কমাবেন না, আর আল্লাহ এটার ওপর সন্তুষ্ট হয়ে গেছে; সুতরাং কখনো আর রাগান্বিত হবেন না।’ (তাফসিরু ইবনি কাসির : ৩/২২-২৩, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)

সুতরাং মিলাদুন্নবি যদি মুসতাহাব ও সবার সেরা ইদই হতো তাহলে এটা বলা আবশ্যক হয়ে পড়বে যে, আল্লাহ তাআলা মিলাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত চালু করার পূর্বেই দ্বীনের পূর্ণতার ঘোষণা দিয়েছেন। এতে কি আল্লাহর ঘোষণা ভুল বলে প্রমাণিত হয় না? নাউজুবিল্লাহি মিন জালিক!

৩ নং দলিল :
মুসতাদরাকে হাকিমে বর্ণিত হয়েছে :
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَطَبَ النَّاسَ فِي حَجَّةِ الْوَدَاعِ، فَقَالَ:… إِنِّي قَدْ تَرَكْتُ فِيكُمْ مَا إِنِ اعْتَصَمْتُمْ بِهِ فَلَنْ تَضِلُّوا أَبَدًا كِتَابَ اللَّهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
‘ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে বললেন, …নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মাঝে এমন জিনিস রেখে যাচ্ছি, যদি তোমরা তা আঁকড়ে ধরো, তবে কখনো বিভ্রান্ত হবে না। সেটা হলো আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহ। (মুসতাদরাকুল হাকিম : ১/১৭১, হা. নং ৩১৮, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)

উক্ত হাদিসে থেকে বুঝা যায়, যে ইবাদতের ভিত্তি কুরআন বা সুন্নাহয় পাওয়া যাবে না, সেটাই গোমরাহি; যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে তা খুব সুন্দরই দেখাক না কেন? এমনকি ইজমা ও কিয়াসের দ্বারাও মৌলিক কোনো ইবাদতের উদ্ভাবন জায়িজ নেই। সুতরাং কুরআন-সুন্নাহ বাদ দিয়ে শুধু অনুমাননির্ভর কিয়াসের ওপর ভিত্তি করে মিলাদুন্নবি প্রমাণের বৃথাই প্রচেষ্টা বাতুলতা বৈ কিছু নয়।

৪ নং দলিল :
সুনানে তিরমিজিতে বর্ণিত হয়েছে:
قَالَ أَنَسُ بْنُ مَالِكٍ، قَالَ لِي رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَا بُنَيَّ، إِنْ قَدَرْتَ أَنْ تُصْبِحَ وَتُمْسِيَ لَيْسَ فِي قَلْبِكَ غِشٌّ لأَحَدٍ فَافْعَلْ ثُمَّ قَالَ لِي: يَا بُنَيَّ وَذَلِكَ مِنْ سُنَّتِي، وَمَنْ أَحْيَا سُنَّتِي فَقَدْ أَحَبَّنِي، وَمَنْ أَحَبَّنِي كَانَ مَعِي فِي الجَنَّةِ
‘আনাস বিন মালিক রা. বলেন, আমাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে প্রিয় বৎস, যদি তুমি সকাল-সন্ধ্যা এভাবে কাটাতে পারো যে, তোমার অন্তরে কারও প্রতি কোনোরকম বিদ্বেষ নেই, তাহলে তাই করো। তিনি আমাকে পুনরায় বললেন, হে বৎস, এটা হলো আমার সুন্নাত। আর যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতকে জীবিত করল সে আমাকে ভালোবাসল। আর যে আমাকে ভালোবাসল সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে।’ (সুনানুত তিরমিজি : ৪/৩৪৩, হা. নং ২৬৭৮, দারুল গারবিল ইসলামি, বৈরুত)

মিলাদুন্নবি পালনকারীদের দাবি হলো, মিলাদুন্নবিই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি প্রেম-ভালোবাসা প্রকাশের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। এজন্য যারা এর বিরোধিতা করে, তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দুশমন। এভাবেই তারা বলে থাকে। অথচ পাঠক পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন, তিরমিজির এ হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে মহব্বতের সঠিক নিয়ম বলে দেয়া হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাত পালনই হলো তাঁর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের প্রকৃত মাধ্যম।

এখন আমাদের দেখতে হবে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্মদিন উপলক্ষ্যে কোনো আমল বা কিছু করেছেন কিনা। হাদিসের ভাণ্ডারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, হ্যাঁ, তিনি তাঁর জন্মের শুকরিয়াস্বরূপ নিয়মিত একটি সাপ্তাহিক আমল করেছেন, যা একাধিক হাদিসের কিতাবে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হয়েছে।

সুনানে তিরমিজিতে বর্ণিত হয়েছে :
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَتَحَرَّى صَوْمَ الاِثْنَيْنِ وَالخَمِيسِ
‘আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সোমবার ও বৃহস্পতিবারের রোজার ব্যাপারে খুব খেয়াল রাখতেন ‘ (সুনানুত তিরমিজি : ২/১১৩, হা. নং ৭৪৫)

সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে :
عَنْ أَبِي قَتَادَةَ الْأَنْصَارِيِّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ… وَسُئِلَ عَنْ صَوْمِ يَوْمِ الِاثْنَيْنِ؟ قَالَ: ذَاكَ يَوْمٌ وُلِدْتُ فِيهِ، وَيَوْمٌ بُعِثْتُ – أَوْ أُنْزِلَ عَلَيَّ فِيهِ
‘আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, …আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে সোমবারে রোজা রাখার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, এদিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং এদিনেই আমার ওপর অহি নাজিল হয়েছে।’ (সহিহু মুসলিম : ২/৮১৯, হা. নং ১১৬২, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)

তথাকথিত আশেকে রাসুল যারা, তারা কিন্তু বিশুদ্ধ এ সুন্নাহর কথা জানেই না, আর কেউ জানলেও এর ওপর আমলের ব্যাপারে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কারণ, এটা তো কষ্ট ও মুজাহাদার সুন্নত। বছরের বায়ান্নো সপ্তাহে বায়ান্নোটি রোজা রাখা তো এত সহজ নয়। এসব নামধারী আশেকে রাসুলরা তো কেবলই মিষ্টি সুন্নাত খুঁজে বেড়ায়; যদিও তা আদৌও সুন্নাত বলে প্রমাণিত না হোক, কিংবা উলামায়ে কিরাম তা বিদআত বলে আখ্যায়িত করুক। মূলত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিশুদ্ধ সুন্নাহ ও আদর্শ বাদ দিয়ে যারা নিজেদের আবিষ্কৃত পদ্ধতিতে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সন্তুষ্টি খোঁজে, তারা হয় চরম অজ্ঞ নাহয় বন্ধুবেশি দুশমন।

তাহলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাত সোমবারে রোজা না রেখে নিজেদের আবিষ্কৃত পন্থা মিলাদের মাধ্যমে নিজেদেরকে আশেকে রাসুলুল্লাহ বলা কি যুক্তিযুক্ত? এটা তো সম্পূর্ণরূপে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে দুশমনি যে, তাঁর প্রতিষ্ঠিত সুন্নাতকে মৃত করে নিজেদের বানানো পদ্ধতির প্রচার-প্রসার করে নিজেদেরকে আশেকে রাসুল দাবি করছে। অথচ রাসুলের ভাষ্য অনুযায়ী এরা রাসুলের আশেক তো দূরে থাক; বরং তাঁর সুন্নাহর বিরোধিতা করায় এরাই রাসুলের দুশমন।

আল্লাহ তাআলা এদের সবাইকে হিদায়াত দান করুন আর কপালে হিদায়াত না থাকলে এদের বিভ্রান্তকর কর্মকাণ্ড ও গোমরাহি থেকে মুসলিম জাতিকে রক্ষা করুন।

-মুফতি তারেকুজ্জামান দা.বা.

You may also like...

error: Content is protected !!